জুমার প্রথম খুতবা: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস
আজ শুক্রবার। জুমার দিন। ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ইংরেজি, ১৮ ভাদ্র ১৪২৯ বাংলা, ০৫ সফর ১৪৪৪ হিজরি। সফরের প্রথম জুমা আজ। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস তথা তাওহিদ সম্পর্কিত খুতবা। তাওহিদ সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনা কী?
সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি একক, তার কোনো অংশীদার নেই। যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক। যার পরে আর কোনো নবি নেই। এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন-
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ
‘বলুন, তিনি আল্লাহ, এক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তার সমতুল্য কেউ নেই।' (সুরা ইখলাস)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
‘আপনার আগে আমি যে রাসুলই পাঠিয়েছি, তাকে এ আদেশই দিয়েছি যে, আমি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ২৫)
এসবই হচ্ছে তাওহিদের উপমা। তাওহিদের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদ। আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা। তাওহিদ এক ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, যার মধ্যে আছে- রুবুবিয়্যাত (প্রভুত্ব), উলুহিয়্যাত (ইবাদত) ও আসমা ওয়াস সিফাত (আল্লাহর নাম ও গুণাবলী)।
তাওহিদ হচ্ছে শিরকের বিপরীত। এই তাওহিদই হচ্ছে ইসলামের মূল ভিত্তি। যার উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। আর তা হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’-এর সাক্ষ্য প্রকাশ পায়।
তাওহিদ হচ্ছে ঐ জিনিস যার উচ্চারণের মাধ্যমে একজন অবিশ্বাসী ইসলামে প্রবেশ করে। আরকোনো মুসলিম যদি তা অস্বীকার কতে বা ঠাট্টা তামাশা করে তখন সে কাফিরের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়।
তাওহিদ হচ্ছে সব রাসুলদের দাওয়াতের মূল কথা। যার দিকে তাঁরা উম্মতেদের আহ্বান করেছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর অনুসারীদেরকে ছোট থেকেই তাওহিদের ওপর গড়ে তুলেছেন। তাঁর চাচাতো ভাই হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে (যিনি ছোট বালক ছিলেন) বলেছেন-
‘যদি কোনো কিছু চাও তবে শুধু আল্লাহর কাছেই চাও। যদি সাহায্য চাও তবে তাঁরই কাছে চাও।’ (তিরমিজি)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিদের শিক্ষা দেন যে, সর্ব প্রথম মানুষকে তাওহিদের দিকে দাওয়াত দেবে। তাই হজরত মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে যখন তিনি ইয়ামান পাঠান তখন বলেন-
‘অবশ্যই সর্ব প্রথমে তাদেরকে (ইয়ামানবাসীকে) যে দাওয়াত দেবে তাহলো এই সাক্ষ্য যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। অন্যত্র এসেছে, ‘আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি’। (বুখারি ও মুসলিম)
প্রাণহীন দেহ যেমন অসাড়, তেমন তাওহিদবিহীন ইসলামের মূল্যও অর্থহীন। তাওহিদের কারণেই আল্লাহ তাআলা পুরো জগত সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
‘নিশ্চয়ই আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা যারিয়াত : আয়াত ৫৬)
এই আয়াতে ইবাদত অর্থ আল্লাহর একত্ববাদ ও অদ্বিতীয়তা প্রকাশ করা হয়েছে। তাওহিদের উপরই নির্ভর করছে মানুষের দুনিয়া ও পরকালের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য।
তাওহিদুর রুবুবিয়্যাত
প্রভুত্বের ক্ষেত্রে একত্ববাদ। তাওহিদে রুবুবিয়্যাত হলো এ কথা স্বীকার করা যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং দুনিয়ায় একাধিক সৃষ্টিকর্তা নেই। একমাত্র আল্লাহ তাআলাই রিজিকদাতা ও অন্যান্য সব কিছু প্রদানকার। আর এ একত্ববাদ চির সত্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাআলা একমাত্র চিরঞ্জীব, মহাশক্তিশালী স্রষ্টাই হচ্ছে খাদ্যদাতা, জীবনদাতা, আইনদাতা, মৃত্যুদানকারী, বিশ্বজগৎ পরিচালনা ও প্রতিপালনকারী। তিনিই সব কিছু করে থাকেন।
আল্লাহর প্রভুত্বে কারো কোনো অংশীদারিত্ব নেই। আসমান ও জমিনের সব প্রাণীই তাঁরই দয়ার ভিক্ষুক। তিনিই একমাত্র সব ক্ষমতার মালিক। দুনিয়ার সব শক্তি একত্রিত হয়েও মহান আল্লাহর কোনো সিদ্ধান্তের পরিবর্তন বা রদ করতে পারবে না। যদি কেউ মনে করে এ রকম গুণ কোনো সৃষ্ট জীবের মধ্যে আছে তাহলে সে মুশরিকদের মধ্যে গণ্য হবে।
তাওহিদুল উলুহিয়্যাত
ইবাদতের ক্ষেত্রে একত্ববাদ। এটা হচ্ছে সে তাওহিদ যেদিকে সব রাসুল মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। আর তাহলো এক আল্লাহর ইবাদত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولاً أَنِ اعْبُدُواْ اللّهَ وَاجْتَنِبُواْ الطَّاغُوتَ فَمِنْهُم مَّنْ هَدَى اللّهُ وَمِنْهُم مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلالَةُ فَسِيرُواْ فِي الأَرْضِ فَانظُرُواْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ
‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক। এরপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে আল্লাহ হেদায়েত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেল। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ মিথ্যারোপকারীদের কিরূপ পরিণতি হয়েছে।’ (সুরা নাহল : আয়াত ৩৬)
তাওহিদু আসমা ওয়াস সিফাত
আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর একত্ববাদ। এটা হলো আল্লাহর নামসমূহ ও তাঁর গুণাবলীর ওপর ঈমান। মহান আল্লাহ যেভাবে তাঁর পবিত্র গন্থে তাঁর ও তাঁর গুণের কথা উল্লেখ করেছে এবং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে আল্লাহর সে গুণের উল্লেখ রয়েছে ঠিক সেভাবেই তাঁর প্রতি ঈমান নিয়ে আসাই হচ্ছে সব একত্ববাদী ঈমানদারদের একমাত্র পথ। আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর প্রতি সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণ এবং চার ইমাম অনুরূপ বিম্বাস স্থাপন করেছেন। এতে কোনো প্রকার মন্তব্যের অবতারণা করেননি।
কালেমার প্রতি বিশ্বাস
কালেমা তাইয়্যেবা যারা মানবে ও বিশ্বাস করবে, তাদের প্রতি এই কালেমার আদেশ এই যে, তারা যেন এই ধরনের কোনো নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব কোনোক্রমেই স্বীকার না করে যে, অন্যায় নীতি বা পাপ কাজের আদেশ দেওয়া। আর তা কোনো পীর-বুজুর্গ, রাজা-বাদশাহ, নেতা-মাতব্বর, আলিম-মাওলানা; যারাই হোক না কেন; কোনো কিছুতেই তা মেনে নেওয়া যাবে না। এমনকি সবচেয়ে বেশি মান্য করার আদেশ দেওয়া হয়েছে বাবা-মাকে। কিন্তু তাওহিদ স্বীকার করার পর সেই বাবা-মাও কোনো অন্যায় আদেশ দিলে তা মানা যাবে না। আল্লাহ তাআলা তা পরিষ্কার করে নিষেধ করেছেন এভাবে-
وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
‘বাবা-মা যদি তোমাকে আমার সঙ্গে এমন বিষয়কে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সঙ্৯েগ সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। এরপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৫)
অন্য আয়াতে এসেছে-
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلْ أَفَرَأَيْتُم مَّا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ
‘যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, আসমান ও জমিন কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে- ‘আল্লাহ’। বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ আমার অনিষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তবে তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ডাক, তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি রহমত করার ইচ্ছা করলে তারা কি সে রহমত রোধ করতে পারবে? বলুন, আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে।’ (সুরা যুমার : আয়াত ৩৮)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহিদের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস