ইসলামে পবিত্র হজের গুরুত্ব ও ফজিলত

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:১৯ পিএম, ০৫ জুলাই ২০২২

ফখরুল ইসলাম নোমানী

‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননিমাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাক।’ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য-ভ্রাতৃত্বের মহাসম্মেলন হজ। ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে হজ চতুর্থ, যা অবশ্যই পালনীয়। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে চলতি বছরের ৮-৯ জুলাই (৯ জিলহজ) পবিত্র হজ পালিত হবে। তার আগেই হজযাত্রীসহ প্রত্যেক মুসলমানের উচিত পবিত্র হজের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জানা। হজের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা বা সংকল্প। আর হজের পারিভাষিক সংজ্ঞা সম্পর্কে ইহয়াউল-উলুম গ্রন্থকার বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাবলির মাধ্যমে পবিত্র কাবাঘর জিয়ারত করার ইচ্ছা পোষণ করাকেই হজ বলে।’

হজ আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ বিধান। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সমর্থ পুরুষ ও নারীর ওপর হজ ফরজ। হজ সম্পর্কে কোরআন শরিফে আল্লাহতাআলা বলেন, আল্লাহর তরফ থেকে সেই সব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে। যারা তা আদায়ের সামর্থ রাখে। (সুরা আল ইমরান, আয়াত ৯৭)।

হাজার বছরের স্মৃতিবিজড়িত এই হজের প্রতিটি কার্যক্রমে রয়েছে মানবজাতির সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মুসলমানদের জন্য এটি একটি ফরজ ইবাদত। কালেমা মুসলমানদের প্রথম ইবাদত। যার দ্বারা সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ইসলাম ধর্মে পদার্পণ করে। এরপর নামাজ রোজা হলো মুসলমানদের জন্য শারীরিক ইবাদত। আর হজ হলো শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত। এ জন্য হজ আদায় করা সবার ওপর ফরজ নয়। শুধু প্রত্যেক সুস্থ ও সামর্থবান ব্যক্তির ওপরই যথাসময়ে হজ আদায় করা ফরজ।

নবিজি (সা.) বলেছেন, প্রকৃত হজের পুরস্কার বেহেশত ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা হজ পালন করবেন, আল্লাহ তাআলা তাদের হজ কবুল করবেন। তাদের জন্য অফুরন্ত রহমত ও বরকত অবধারিত। জীবনে একবার হজ করা ফরজ। সুযোগ থাকলে বারবার বা প্রতিবছর হজ করায় বাধা নেই। যে কারো অর্থ দ্বারা হজ সম্পাদন করা যাবে। হাদিয়া বা অনুদানের টাকা দিয়েও হজ করলে তা আদায় হবে। চাকরি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল হিসেবে কর্তব্য কাজের সুবাদে হজ করলেও হজ আদায় হবে। এটি বদলি হজ না হলে নিজের ফরজ হজ আদায় হবে; ফরজ হজ পূর্বে আদায় করে থাকলে এটি নফল হবে। নফল হজ অন্য কারো বদলি হজের নিয়তে আদায় করলে তা-ও হবে।

রাসুলে করিম (সা.) বলেন, হজ মানুষকে নিষ্পাপে পরিণত করে যেভাবে লোহার ওপর থেকে মরিচা দূর করা হয়। (তিরমিজি)। রাসুলে করিম (সা.) আরও বলেন, যে ব্যক্তি যথাযথভাবে হজ পালন করে সে পূর্বেকার পাপ থেকে এরূপ নিষ্পাপ হয়ে যায়; যেরূপ সে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন নিষ্পাপ ছিল। (বুখারি ও মুসলিম)। হজ প্রতিপালনে নিজে শারীরিকভাবে অক্ষম হলে অন্য কাউকে দিয়ে বদলি হজ করানো যায়। বদলি হজে যিনি হজ সম্পাদন করেন, যিনি অর্থায়ন করেন এবং যার জন্য হজ করা হয়, সবাই পূর্ণ হজের সওয়াব লাভ করেন। যারা সামর্থ থাকার পরও হজ আদায় করতে পারেননি, তাদের কর্তব্য হলো বদলি হজ করানোর জন্য অসিয়ত করে যাওয়া। অসিয়তকৃত বদলি হজ অসিয়তকারীর সম্পদ বণ্টনের পূর্বে প্রতিপালন করা বা সম্পাদন করানো ওয়ারিশদের জন্য ওয়াজিব।

মৃত বা জীবিত যে কারো বদলি হজ করানো যায়। আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব অথবা পরিচিত-অপরিচিত যে কেউ যে কারো বদলি হজ করতে বা করাতে পারেন। বদলি হজ সম্পাদনের জন্য আগে নিজের হজ আদায় করা শর্ত নয়; বরং নতুনদের দ্বারা বদলি হজ করালে তার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, আবেগ ও অনুরাগ বেশি থাকে। তবে যার ওপর হজ ফরজ অথচ নিজে আদায় করেননি, তিনি বদলি হজ করতে পারবেন না। বদলি হজ আত্মীয়-অনাত্মীয়, নারী-পুরুষ যে কেউ করতে পারেন। তবে বিজ্ঞ পরহেজগার লোক হলে উত্তম।

এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, হজ কবুল হওয়ার জন্য তিনটি কাজ যথার্থভাবে আদায় করতে হয়:
১. নিয়ত সহিহ করা
২. নির্দিষ্ট সময়েই হজ করা
৩. নির্দিষ্ট কার্যাবলির মাধ্যমে হজ করা।
এ তিন কাজের মধ্যে যে কোনো একটি কাজ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে আদায় করতে ব্যর্থ হলে হজ আদায় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

হজ আদায়ের গুরুত্ব ও ফজিলত
হজের সব কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদনে যেমন আছে কষ্ট; তেমনই আছে অনেক ফজিলত। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বিভিন্ন হাদিসে হজের অনেক ফজিলতের কথা বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ অথবা ওমরা কিংবা আল্লাহর রাস্তায় জেহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে অতঃপর সে ওই পথেই মৃত্যুবরণ করেছে। আল্লাহ তাআলা তার জন্য গাজ হাজি অথবা ওমরা পালনকারীর সওয়াব লিখে দেবেন। (মিশকাত শরিফ: ২৪২৪) হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করল এবং স্ত্রী সহবাস, যাবতীয় অশ্লীল কাজ ও গালমন্দ থেকে বিরত থাকল; সে ওইদিনের মতো (নিষ্পাপ) হয়ে ফিরল। যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিল। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত) রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ অথবা ওমরার জন্য বায়তুল মাকদিস হতে মাসজিদুল হারাম পর্যন্ত গমনের ইহরাম বাঁধে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। অথবা তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে। (আবু দাউদ: ১৭৪১) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন তোমরা হজ ও ওমরা পরপর একত্রে আদায় করো। কেননা এ হজ ও ওমরা দারিদ্র্য ও গোনাহ দূর করে দেয়। লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা যেমনভাবে হাপরের আগুনে দূর হয়ে যায়। আর কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়। (আত-তিরমিজি: ৮১০) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, হজযাত্রীরা ও ওমরার যাত্রীরা আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা তার কাছে দোয়া করলে তিনি তাদের দোয়া কবুল করেন এবং তার কাছে মাফ চাইলে তিনি তাদের ক্ষমা করেন। (ইবনে মাজাহ: ২৮৯২)

হজের প্রকারভেদ
হজ তিন প্রকার। যেমন- তামাত্তু, ইফরাদ, কিরান। এর মধ্যে সওয়াবের দিক দিয়ে সর্বাধিক উত্তম হলো কিরান এরপর তামাত্তু এরপর ইফরাদ। তবে আদায় সহজ হওয়ার দিক থেকে প্রথমে তামাত্তু, এরপর ইফরাদ এরপর কিরান। তামাত্তু হজ পালন করা সবচেয়ে সহজ তাই অধিকাংশ বাংলাদেশি তামাত্তু হজ আদায় করে থাকেন। আর যারা অন্যের বদলি হজ করতে যান বা যাদের অবস্থান মিকাতের মধ্যে তারা সাধারণত ইফরাদ হজ করেন। এ ছাড়া কিছুসংখ্যক হাজি কিরান হজ করেন, যাদের সংখ্যা খুবই কম।

মনে রাখতে হবে
হজ প্রতিটি মানুষের জন্য খুবই গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। কারণ, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সাহাবির জিজ্ঞাসাবাদে সর্বোত্তম তিনটি বিশেষ কাজের মধ্যে হজের কথাও বলেছিলেন। বিষয়টি হাদিসে এভাবে এসেছে: হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সর্বোত্তম কাজ কোনটি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ এবং তার রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। এরপর কী? তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। এরপর কী? তিনি বলেছিলেন, মাবরুর হজ। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত) সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত আল্লাহর জন্য নবিজির দেখানো নিয়েম হজ পালনের মাধ্যমে গুনাহ ও দারিদ্র্যমুক্ত জীবন পাওয়ার চেষ্টা করা। নিষ্পাপ হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করে পরকালে সুনিশ্চিত জান্নাতের অধিকারী হওয়া।

হজ ফরজ হওয়ার শর্তাবলি
কারো ওপর হজ ফরজ হওয়ার জন্য ইসলামি শরিয়তে কয়েকটি শর্তারোপ করা হয়েছে। নিম্নে উল্লিখিত শর্তগুলো যাদের মধ্যে পাওয়া যাবে, তাদের ওপর যথাসময়ে হজ আদায় করা ফরজ-
১. মুসলমান হওয়া
২. স্বাধীন হওয়া
৩. পূর্ণ বয়সপ্রাপ্ত ও জ্ঞানবান হওয়া
৪. শারীরিকভাবে সুস্থ হওয়া
৫. দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন হওয়া
৬. হজে যাতায়াতের রাস্তা নিরাপদ হওয়া
৭. নারীর সঙ্গে স্বামী বা অন্য কোনো মুহরেম পুরুষ থাকা
৮. পরিবারের খরচ ছাড়া অবশ্যই হজের সব খরচ বহন করার সামর্থ থাকা।
শর্তগুলো কারো মধ্যে থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ গড়িমসি করে হজ আদায় না করে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তার কঠিন শাস্তির ব্যাপারে নবিজি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এতটুকু পাথেয় ও বাহনের মালিক হয়েছে যা তাকে আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। অথচ সে হজ আদায় করেনি সে ইহুদি অথবা খ্রিষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করুক, তাতে কিছু আসে-যায় না। (তিরমিজি: ৮১২)

আল্লাহ যেন আমাদের জীবনে অন্তত একবার হলেও তার ঘর জিয়ারত করার তৌফিক দান করেন। সবাইকে হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে যথাসময়ে হজ পালন করার তৌফিক দান করেন। আমিন!

লেখক: ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।