১৭ শ্রেণির মানুষ জান্নাতে যাবে না
জান্নাত মানুষের স্থায়ী ঠিকানা। মানুষ জান্নাতেই ছিলো। ক্ষণিকের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ মানুষ দুনিয়াতে এসেছে। পরকালের হিসাব-নিকাশের পর মানুষ জান্নাতে যাবে। কিন্তু ১৭ শ্রেণির মানুষ জান্নাতে যেতে পারবে না। তারা কারা?
এমন কোনো মানুষই খুঁজে পাওয়া যাবে না; যারা জান্নাতে যেতে চায় না। কিন্তু নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের কিছু কাজ ও আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। যারা তাদের আচরণের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। নবিজীর ঘোষণায় ১৭ শ্রেণির মানুষের কাজ ও আচরণের কথা ওঠে এসেছে। তাহলো-
১. অবিশ্বাসী বান্দা
জান্নাত পাওয়া প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। কেননা নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ঈমানদার ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
তিনি আরও বলেন, ‘ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন না’ (মুসলিম)
২. নিষ্ঠুর প্রতিবেশী
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার অনিষ্ট (কষ্ট) থেকে তার প্রতিবেশি নিরাপদ নয়; সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম)
৩. অহংকারী ব্যক্তি
নবিজী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম)
৪. চোগলখোর ও পরনিন্দাকারী
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘চোগলখোর বা পরনিন্দাকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম)
তিনি আরও বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন সবচেয়ে খারাপ লোকদের অন্তর্ভূক্ত ঐ ব্যক্তিকে দেখতে পাবে যে, যে ছিল দুমুখো। যে এক জনের কাছে একরকম কথা আরেক জনের কাছে ভিন্নরকম কথা নিয়ে হাজির হতো।’(মুসলিম)
৫. আত্মহত্যাকারী
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে (পরকালে) সব সময় সে ওইভাবে (দুনিয়ার মতো) নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যেমন-
> যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সব সময় ওইভাবে সে বিষ পাণ করে নিজেকে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে।
> যে ব্যক্তি কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে, যার দ্বারা সে সব সময় সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকরা
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম)
৭. হারাম খাওয়া ব্যক্তি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হারাম অর্থের মাধ্যমে (যে শরীরে) মাংস বৃদ্ধি পেয়েছে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি হারাম অর্থ ও অবৈধ উপার্জন দ্বারা দেহ গঠন (জীবিকা নির্বাহ) করেছে, জাহান্নামের আগুনই তার প্রাপ্য।’ (মিশকাত)
৮. খোটা দেওয়া ব্যক্তি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যে উপকার করে খোটা দেয়।’ (নাসাঈ)
৯. তাকদির (ভাগ্য) অস্বীকারকারী ও অবাধ্য সন্তান
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপায়ী এবং তাকদিরের প্রতি অস্বীকারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সিলসিলা)
১০. জ্যোতিশ, জাদুকর, মাদক তথা নেশাকারী
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘৫ শ্রেণীর মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (তারা হলো) মদ্যপায়ী, যাদুর বৈধতায় বিশ্বাসী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, চোগলখোর এবং গণক তথা জ্যোতিশ ব্যক্তি।’ (মুসনাদে আহমদ)
১১. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোনো ঋণগ্রস্ত মৃতের লাশ (জানাযার জন্য) নিয়ে আসা হলে (তিনি) জিজ্ঞাসা করতেন, ‘সে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করেছে কি না? যদি বলা হতো করেছে, তবে জানাযা পড়তেন। অন্যথায় (সাহাবীদেরকে) বলতেন- তোমরা তোমাদের সাথীর জানাযা পড়ে নাও।’ (কিন্তু তিনি নিজে তাতে অংশ গ্রহণ করতেন না)। (মুসলিম)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘ঋণ ছাড়া শহিদের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (মুসলিম)
১২. পুরুষ বেশধারী নারী ও দাইয়ুস
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘৩ শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তারা হলো- ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, দাইয়ূস এবং পুরুষ বেশধারী নারী।’ (সহিহ জামে)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তিকে দাইয়ুস বলা হয়, যে তার পরিবারের অশ্লীলতা ও কুকর্মকে মেনে নেয়।’ (মুসনাদ আহমদ, নাসাঈ)
১৩. ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক, অহংকারী গরিব
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ ৩ শ্রেণীর লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদেরকে গোনাহ থেকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তারা হলো- ‘বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী শাসক এবং অহংকারী গরিব।’ (মুসলিম)
১৪. কঠোরতা অবলম্বকারী ও কটুভাষী ব্যক্তি
যে ব্যক্তি মানুষের কাছে এমন বিষয় নিয়ে গর্ব-অহংকার করে বেড়ায়; প্রকৃতপক্ষে যা তার কাছে নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কঠোর প্রকৃতি ও কটুভাষী লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং ওই লোকও নয়, যে এমন সব বিষয়ে মানুষের কাছে গর্ব-অহংকার প্রকাশ করে বেড়ায় প্রকৃতপক্ষে যা তার কাছে নেই।’ (আবু দাউদ)
১৫. অঙ্গীকারগ্রহণকারী অমুসলিমকে হত্যাকারী
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিম সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বসবাসকারী কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের পথের দূর থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (বুখারি)
১৬. বিশ্বাস ঘাতকতাকারী শাসক
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা যাকে জনসাধারণের শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, কিন্তু সে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং বিশ্বাসঘাতক থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (মুসলিম)
১৭. অন্যায়ভাবে মানুষকে নির্যাতনকারী ও পর্দাহীন নারী
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘২ শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামে যাবে। যাদের আমি এখনো দেখি নি। (রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে তাদের আত্মপ্রকাশ হয়নি) তারা হল-
> এমন কিছু লোক যাদের হাতে থাকবে গরুর লেজের মত লাঠি। তারা তা দিয়ে জনগণকে মারধর করবে।
> আর ওই সব উলঙ্গ-অর্ধ উলঙ্গ বেপর্দা নারী যারা (নিজেদের চলাফেরা ও বেশ-ভূষায়) মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করবে এবং নিজেরাও অন্য মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা উটের মত উঁচু হবে এবং একপাশে ঝুঁকে থাকা চূড়ার মতো কেশ রাশি শোভা পাবে। এ সব নারী জান্নাতে তো যাবেই না বরং জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না অথচ বহুদূর থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (মুসলিম)
তবে আশার বাণী হলো-
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের সব গোনাহ মাপ করে দিবেন। যদিও উপরোক্ত কাজগুলো কবিরাহ গোনাহের অন্তর্ভূক্ত।
যারা উল্লেখিত কাজগুলো থেকে তাওবাহ করে আল্লাহর পথে ফিরে আসবে। আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা তাওবাকারী বান্দাদের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। উল্লেখিত গোনাহে জড়িত ব্যক্তি যদি এ গোনাহ থেকে ফিরে আসে এবং এর প্রতিকারমূলক কাজ করে এবং পুনরায় এসব গোনাহ না করে যথাযথভাবে তাওবাহ করে তবে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন। কেননা মহান আল্লাহ তাওবাহকারীকে ভালোবাসেন। বান্দাহকে ক্ষমা করতেও ভালোবাসেন।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তাআলা নিজ দয়া ও ইনসাফের ভিত্তিতে এদের মধ্যে যাকে খুশি ক্ষমা করে দেবেন যদি সে শিরক থেকে দূরে থাকে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না, যে ব্যক্তি তাঁর সাথে শরিক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৪৮)
তাছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মারা গেল যে, (জীবিত অবস্থায়) সে ভালো করে জানত, ‘আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই, সে ব্যক্তি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসলিম)
আবার পরকালের ফয়সালার সময় ঈমান থাকা সত্বেও আল্লাহ তাআলা যাদেরকে ক্ষমা করবেন না তাদেরকে তিনি জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন। পাপের শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
কবিরা গোনাহে জড়িত ব্যক্তিরা প্রথম পর্যায়ে জান্নাতে প্রবেশকারীদের সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে না বরং জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করে পরিশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কোনো তওহীদপন্থী ব্যক্তিই কাফেরদের মতো চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে অবস্থান করবে না। আর এটাই হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদাহ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসে ঘোষিত জান্নাতের অন্তরায় কাজগুলো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ বিধান যথাযথ বাস্তবায়ন করে জান্নাত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম