মানুষের জীবনে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র গুরুত্ব ও মর্যাদা
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা। মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর প্রভাব, গুরুত্ব, মর্যাদা এবং ফজিলত অনেক বেশি। মুসলিম উম্মাহ তাদের আজান, ইকামাত, বক্তৃতা-বিবৃতি এবং আলোচনা-সভা-সমাবেশে বলিষ্ঠ কণ্ঠে এ সত্য ঘোষণা দেন- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’।
তাওহিদের ঘোষণটি শুধু এ যুগের মানুষের জন্যই নয় বরং আসমান-জমিনসহ সমগ্র মাখলুকত সৃষ্টি হয়েছে এ কালেমার জন্য। এর প্রচার-প্রসারে যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল আগমন করেছেন। মানুষের জীবনে এ কালেমার রয়েছে অসংখ্য প্রভাব। কে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর অনুসারি আর কে এর বিরোধিতাকারী এসব নির্ধারণে আল্লাহ তাআলা নাজিল করেছেন আসমানি কিতাব, দিয়েছেন অসংখ্য বিধান।
এ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র জন্যই পরকালের মিজান, হাশর, পুলসিরাত ও কেয়ামতের দিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব অনুষ্ঠিত হবে। তাওহিদের কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা’য় হবে জান্নাত এবং জাহান্নামের চূড়ান্ত ফয়সালা।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সেই কালেমা; যার স্বীকার আর অস্বীকারের মাধ্যমে ঈমানদার আর কুফরে পাথর্ক্য হবে মানুষ। সৃষ্টি জগতের প্রতিটি মানুষের জীবনে এ কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র একচ্ছত্র প্রভাবই বেশি। এর উপরই নির্ভর করে সব পুরস্কার ও তিরস্কার।
এ কালেমার ভিত্তিতেই মানুষ পাবে সওয়াব ও শাস্তি। এ ঘোষণা প্রতিষ্ঠার উপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয় মুসলমানদের কেবলা। এ কালেমার আহ্বানেই মুসলমানের হাতে শোভা পায় খাপ থেকে বের হয়ে আসা খোলা তরবারি। এ কালেমাই হবে মানুষের সব প্রাপ্তি ও বিসর্জনের কারণ। এ কালেমার ব্যাপারে শুরু থেকে শেষ সব নবি-রাসুল ও অনুসারীরা আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবে। যারা এর সঠিক জিম্মাদারি পালন করতে পেরেছেন এবং পারবেন তারাই হবে সফল। আর যারা এর জিম্মাদারিতে দূরে তারা হবেন চরম লাঞ্ছিত ও অপমানিত।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা’র স্বীকৃতির জিজ্ঞাসাবাদ
চিন্তার বিষয়, আল্লাহ কেয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই জিজ্ঞাসা করবেন- তুমি কার ইবাদত করেছ? নবি-রাসুলদের আহ্বানে কতটুকু সাড়া দিয়েছ? এ প্রশ্নের উত্তর সব ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলক দিতেই হবে।
প্রথম প্রশ্নের সঠিক উত্তর হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’কে (لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ) ভালোভাবে জেনে এর স্বীকৃতি দেওয়া এবং কালেমা দাবি অনুযায়ী কাজ করা।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো- মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসুল হিসাবে মেনে তাঁর নির্দেশের আনুগত্য করা।
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নসিহত
যুগে যুগে এ কালেমার স্বীকৃতি ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন অসংখ্য নবি-রাসুলগণ। এ কালেমাই রেখে গেলেন গেছেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। কোরআনে এসেছে-
وَ جَعَلَهَا کَلِمَۃًۢ بَاقِیَۃً فِیۡ عَقِبِهٖ لَعَلَّهُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ
‘এ ঘোষণাকে সে চিরন্তন বাণীরূপে তার পরবর্তীদের জন্য রেখে গেছে; যাতে ওরা (সৎপথে) প্রত্যাবর্তন করে।’(সুরা যুখরুফ : আয়াত ২৮)
আল্লাহ ও ফেরেশতা কর্তৃক কালেমার সাক্ষ্য
এই সেই কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’; যার সাক্ষ্য দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা নিজে, ফেরেশতা এবং জ্ঞানীগণও দিয়েছেন-
شَهِدَ اللّٰهُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ۙ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ اُولُوا الۡعِلۡمِ قَآئِمًۢا بِالۡقِسۡطِ ؕ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ
‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই, আর ফেরেশতা ও জ্ঞানীগণও। তিনি ন্যায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৮)
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র প্রচার
এই কালেমা প্রচারের জন্যই আল্লাহ তাআলা সব রাসুল এবং আসমানি কিতাবসমূহ পাঠিয়েছেন। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে কোরআনে এ কথাটি এভাবে বলেছেন-
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا نُوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدُوۡنِ
‘আর আপনার আগে এমন কোনো রাসুল আমি পাঠাইনি যার প্রতি আমি এই অহি নাজিল করিনি যে, ‘আমি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই; সুতরাং তোমরা আমার ইবাদাত করো।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ২৫)
আল্লাহ তাআলা অন্যত আরো বলেন-
یُنَزِّلُ الۡمَلٰٓئِکَۃَ بِالرُّوۡحِ مِنۡ اَمۡرِهٖ عَلٰی مَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِهٖۤ اَنۡ اَنۡذِرُوۡۤا اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاتَّقُوۡنِ
‘তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে অহিসহ (প্রত্যাদেশ) ফেরেশতা নাজিল করেন, এই মর্মে সতর্ক করার জন্য যে- ‘আমি ছাড়া কোনো (সত্য) উপাস্য নেই’; সুতরাং তোমরা আমাকে ভয় করো। (সুরা নাহল : আয়াত ২)
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মানুষের জন্য নেয়ামত
সব বান্দার উপর আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে প্রধান এবং বড় নেয়ামত হলো তিনি সবার জন্য (لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ) তাঁর এই একত্ববাদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। দুনিয়ার পিপাসা কাতর তৃষ্ণার্ত একজন মানুষের কাছে ঠাণ্ডা পানির যে মূল্য; আখেরাতে অনন্ত জীবনে জান্নাতবাসীদের জন্য এ কালেমাও ততবেশি মূল্য।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র স্বীকৃতিতে মর্যাদা
যারা এ কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র স্বীকৃতি দান করলো সে তার সম্পদ এবং জীবনের নিরাপত্তা গ্রহণ করলো। আর যারা তা অস্বীকার করলো সে তার জীবন ও সম্পদ নিরাপত্তাহীনতায় ফেললো। হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে তা প্রমাণিত-
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مَنْ دُونِ اللهِ، حَرُمَ مَالُهُ، وَدَمُهُ، وَحِسَابُهُ عَلَى اللهِ
‘যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ এর স্বীকৃতি দান করলো এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সব উপাস্যকে অস্বীকার করলো, তার ধন-সম্পদ ও জীবন নিরাপদ হল এবং তার কৃতকর্মের হিসাব আল্লাহর উপর বর্তালো।’ (মুসলিম)
২. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র দাওয়াতে সাহাবা প্রেরণ
একজন অবিশ্বাসীকে ইসলামের প্রতি আহ্বানের জন্য প্রথমেই চাওয়া হয় এই কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র স্বীকৃতি। তাইতো নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে যখন ইয়ামানে ইসলামের দাওয়াতের জন্য পাঠান তখন তাঁকে নসিহত করেন-
إِنَّكَ تَأْتِي قَوْمًا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ، فَادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنَّ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ
‘তুমি আহলে কিতাবের কাছে যাচ্ছ, অতএব সর্বপ্রথম তাদেরকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আহ্বান করবে।’ (বুখারি, মুসলিম)
মানুষের জীবনের এ কালেমার প্রভাব অত্যধিক। কোরআন-সুন্নাহর অসংখ্য বর্ণনায় তা প্রমাণিত। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র এ স্বীকৃতিকে নিজের জীবনের একমাত্র স্লোগান হিসেবে মেনে নেওয়া, ঘরে-বাইরে, মাঠে-ময়দানে এক কথা সবখানে এর দাওয়াতি কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করা। কারণ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র স্বীকৃতিই হলো মানুষের সব কর্মের মূলভিত্তি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাদের নিজেদের জীবন থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে তাওহিদের কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র উপর যথাযথ আমল ও ঘোষিত কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। এর প্রভাব, মর্যাদা, গুরুত্ব ও ফজিলত উপলব্দি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম