মুহাম্মাদ (সা.) বিশ্ববাসীর জন্য রহমত
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শুভাগমন ছিল বিশ্ববাসীর জন্য আনন্দের। দেড় হাজার বছর আগে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করতেই তাঁর আগমন ঘটেছির। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। তিনি একত্ববাদের সুমহান বাণী নিয়ে আরবের মুরুর বুকে মা আমিনার কোল আলোকিত করে সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্য রহমত নিয়ে জন্ম নিয়েছিলেন। হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনিই রাহমাতুল্লিল আলামিন।
অশান্তি আর অজ্ঞতায় যখন পুরো বিশ্ব অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছিল তখন তিনি অমানিশার এ অন্ধকার দূর করতে শান্তির জীবন ব্যবস্থা ইসলাম নিয়ে দুনিয়ায় আগমন করেন। মানুষের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌছে দেন। তাঁর আগমনেই সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাইতো তিনি সারা বিশ্বের সব মুমিনের কাছে রাহমাতুল্লিল আলামিন।
শুধু মুমিন মুসলমানের জন্য তিনি রাহমাতুল্লিল আলামিন নাকি বিশ্বজাহানের সব মানুষের জন্য রাহমাতুল্লিল আলামিন? হ্যাঁ, তিনি বিশ্বজাহানের সব মানুষের জন্যই রহমত নিয়ে এসেছেন। তাঁর জীবন ইতিহাসই এর সাক্ষী। তিনি ধর্ম বর্ণ গোত্র জাতিগোষ্ঠী নির্বিচারে সবার প্রতি সমতা বিধান করেছিলেন। সবাইকে দিয়েছিলেন ধর্মীয় স্বাধীনতা। কারো প্রতি তিনি জুলুম করেননি। সবার অধিকারের প্রতি তিনি ছিলেন সমাজ সজাগ। তিনি সবার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।
তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-যাতনা সব হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করতেন। ইসলামের সুমহান শিক্ষাও তাই। বাস্তব জবীনে নবি আরাবি নিজেই ইয়াতিম ছিলেন। তাঁর জন্মের আগেই তিনি বাবাকে হারান। মাতৃস্নেহ ও দাদার আদরও বেশি দিন পাননি তিনি। অল্প বয়সে চাচার পরিবারে তার ঠাঁই হয। তিনি চাচা আবু তালিবের নিবিড় যন্তে বেড়ে ওঠেন। আল্লাহ তাআলা তাকে ইয়াতিম হিসেবেই পেয়েছিলেন। তিনিই তাঁকে সঠিক পথের সন্ধান দেন। মানুষের জন্য তাঁর অন্তরে ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। সে কথাই মহান আল্লাহ সুরা দোহায় তুলে ধরেছিলেন এভাবে-
أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآوَى
তিনি কি আপনাকে এতীমরূপে পাননি? এরপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন।’ (সুরা দোহা : আয়াত ৬)
وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدَى
তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথহারা, এরপর পথপ্রদর্শন করেছেন। (সুরা দোহা : আয়াত ৭)
وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَى
তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব, এরপর অভাবমুক্ত করেছেন। (সুরা দোহা : আয়াত ৮)
فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ
সুতরাং আপনি ইয়াতিমের প্রতি কঠোর হবেন না; (সুরা দোহা : আয়াত ৯)
وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ
সওয়ালকারীকে (জানতে চাওয়া লোকদের) ধমক দেবেন না। (সুরা দোহা : আয়াত ১০)
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ
আর আপনার পালনকর্তার নেয়ামতের কথা প্রকাশ করুন। (সুরা দোহা : আয়াত ১১)
চাচা আবু তালিবের কাছে থাকা অবস্থায় তিনি যৌবনে পদার্পন করেন। চাচার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। তাঁর বিশ্বস্ততা ও আমানতদারিতার কারণেই তিনি মক্কার ধনাঢ্য ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী খাদিজার ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনার দায়িত্ব পান। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও চারিত্রিক মাধুর্যে মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী নারী খাদিজা তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। তখন তার বয়স ছিল ২৫ বছর। তিনি হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ে করেন।
৪০ বছর বয়সে তিনি পেয়ে যান মহা সত্যের সন্ধান। তার প্রতি নাজিল হয় আসমানি গ্রন্থ কোরআন। নবুয়তের মহান দায়িত্ব পেয়ে তিনি পথহারা মানুষকে সত্যের পথে আহ্বানের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তার এ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে স্ত্রী হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা। এ সংগ্রামে তাঁর স্ত্রী দান করেন তার সব সম্পদ।
অজ্ঞতার অন্ধকারে পথহারা জাতিকে মুক্তি ও সত্য পথের দিশা দিতে তিনি তাদের কাছে তুলে ধরেন আল্লাহর একত্ববাদের বাণী । কিন্তু বর্বর ও মূর্খ জাতি তাঁর দাওয়াত গ্রহণ না করে বরং তাঁকে নির্যাতন শুরু করে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অল্প সংখ্যক লোক তাঁকে অনুসরণ করার চূড়ান্ত সিন্ধান্ত নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। মহান আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেন। এ দলে সবার আগে ছিলেন তাঁর স্ত্রী হজরত খাদিজাতুল কোবরা রাদিয়াল্লাহু আনহা।
ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসার পর তাঁর বিরুদ্ধে তাঁরই স্বজাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একের পর এক বিভিন্নমুখী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্রই তাকে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচারে দমাতে পারেনি। আল্লাহর সাহায্যের ওপর ভর করে অল্প সংখ্যক সঙ্গী-সাথী নিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জীবনবাজি রেখে দ্বীনের কাজে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যান। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সত্যসন্ধানী মানুষের সংখ্যা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইসলামের দাওয়াত থেকে বিরত রাখতে না পেরে কাফেরদের রাগ-ক্ষোভ প্রচণ্ড রকম বেড়ে যায়। তাদের অত্যাচারের মাত্রা সীমাতিক্রম করে। এক পর্যায়ে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে।
এ কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে জন্মভূমি ত্যাগের নির্দেশ পান। আল্লাহর নির্দেশ এবং দ্বীন কায়েমের স্বার্থে তিনি জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেন। আল্লাহর আইন বাস্তবায়নে সেখানে তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ‘মদিনা সনদ’ নামে একটি লিখিত সংবিধানও প্রণয়ন করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। যে সংবিধানে ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানসহ অন্যান্য সব জাতির মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
মদিনার জীবনে তিনি দুই ধরনের শত্রুর মোকাবেল করেন। একদিকে মদিনার প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা হারানো ইসলামের লেবাসধারণকারী মুনাফিক সম্প্রদায় এবং অপরদিকে মক্কার কাফেরদের অব্যাহত ষড়যন্ত্র। যারা সর্বদাই ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতির পাশাপাশি বিশ্বনবীকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর ছিল। যার ফলশ্রুতিতে সংঘটিত হয় ইসলামের প্রথম দুইটি যুদ্ধ বদর এবং ওহুদ।
বদর যুদ্ধে আল্লাহর অশেষ রহমতে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করলেও মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ও একটি ভুলের কারণে ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদেরকে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। শাহাদাতবরণ করেন অনেক সাহাবি এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাঁত মোবারক শহিদ হয়।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সুদীর্ঘ ২৩ বছরের শ্রম সাধনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিজয় অর্জন করেন। যার পরিপূর্ণতা আসে নিজ জন্মভূমি পবিত্র নগরী মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে।
তাইতো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে দ্বীনের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দেন। যেভাবে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করেন-
‘আজ থেকে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দেয়া হলো। তোমাদের জন্য দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে একমাত্র ইসলামকে মনোনীত করা হয়েছে।’
ইসলামকে পরিপূর্ণ করার মধ্য দিয়ে দুনিয়ার মিশন শেষে ৬৩ বৎসর বয়সে তিনি দুনিয়ার জীবন থেকে বিদায় নেন।
তিনিই বিজয়ী হন। অফুরন্ত ভালোবাসা, রহমত, বরকত ও মাগফেরাতের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। তাঁর এ সুমহান শিক্ষা আজ বিশ্ববাসীর জন্য একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ। দুঃখী-অসহায় মানুষের জন্যও তিনি অনুকরণীয় আদর্শ। তিনিই রাহমাতুল্লিল আলামিন। তাঁর প্রতি অসংখ্য দরূদ ও সালাম।
এমএমএস/এমএস