দুনিয়ায় জীবিত থাকতে যারা বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন
নিঃসন্দেহে সব নবি-রাসুলগণই জান্নাতি। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের প্রথম ৪ খলিফাসহ ১০ জন সাহাবিকে জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। যাদেরকে আশারায়ে মুবাশশারাহ বলা হয়। এদেরকে ছাড়াও তিনি আরো অনেককে দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন; তারা কারা? আর কীভাবেই বা তিনি তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন?
হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, একদিন তিনি নিজ বাড়িতে অজু করে বাইরে গেলেন এবং (মনে মনে) বললেন যে, আজ আমি অবশ্যই আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে থাকব। সুতরাং তিনি মসজিদে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। সাহাবাগণ উত্তর দিলেন যে, তিনি এই দিকে গমন করেছেন।
হজরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি তাঁর পেছনে চলতে থাকলাম এবং তাঁর সন্ধানে (সাহাবাদের) জিজ্ঞাসা করতে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত তিনি ‘আরিস’ কুয়ার (কাছেবর্তী একটি বাগানে) প্রবেশ করলেন। আমি (বাগানের) প্রবেশ দ্বারের পাশে বসে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রাকৃতিক প্রয়োজন সম্পন্ন করে অজু করলেন। অতঃপর আমি উঠে তাঁর দিকে অগ্রসর হলাম। দেখলাম, তিনি আরিস’ কুয়ার পাড়ের মাঝখানে পায়ের নলা খুলে পা দুটো তাতে ঝুলিয়ে বসে আছেন। আমি তাঁকে সালাম দিয়ে আবার ফিরে এসে প্রবেশ পথে বসে রইলাম। আর মনে মনে বললাম যে, আজ আমি অবশ্যই আল্লাহর রসুলের দ্বার রক্ষক হবো।
১. হজরত আবু বকর
সুতরাং আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এসে দরজায় ধাক্কা দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কে?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘আবু বাকর। আমি বললাম, একটু থামুন।
তারপর আমি আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে নিবেদন করলাম, হে আল্লাহ রসূল! উনি আবু বাকর, প্রবেশ করার অনুমতি চান।
তিনি বললেন, 'ওকে অনুমতি দাও। আর তার সাথে জান্নাতের সুসংবাদ জানিয়ে দাও। সুতরাং আমি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর কাছে এসে বললাম, ‘প্রবেশ করুন।’ আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে জান্নাতের সুসংবাদ জানাচ্ছেন।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রবেশ করলেন এবং কুয়ার পাড়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর ডান দিকে পায়ের নলার কাপড় তুলে পা দুখানি কুয়াতে ঝুলিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর মত বসে পড়লেন।
আমি পুনরায় দ্বার প্রান্তে ফিরে এসে বসে গেলাম। আমি মনে মনে বললাম, আমার ভাইকে অজু করা অবস্থায় ছেড়ে এসেছি; (অজুর পরে) সে আমার পেছনে আসবে। আল্লাহ যদি তার জন্য কল্যাণ চান, তাহলে তাকে (এখানে আনবেন)।
২. হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু
হঠাৎ একটি লোক এসে দরজা নড়াল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কে? সে বলল, উমর বিন খাত্তাব। আমি বললাম, একটু থামুন।
এরপর আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর কাছে এসে নিবেদন করলাম যে, উনি উমর। প্রবেশ অনুমতি চান।
তিনি বললেন, ওকে অনুমতি দাও এবং ওকেও জান্নাতের সুসংবাদ জানাও। সুতরাং আমি উমরের কাছে এসে বললাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে প্রবেশ অনুমতি দিয়েছেন এবং জান্নাতের শুভ সংবাদও জানাচ্ছেন।
সুতরাং তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং কুয়ার পাড়ে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর বাম পাশে কুয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে পড়লেন।
আমি আবার সেখানে ফিরে এসে বসে পড়লাম। আর মনে মনে বলতে থাকলাম, আল্লাহ যদি আমার ভাইয়ের মঙ্গল চান, তাহলে অবশ্যই তাকে নিয়ে আসবেন।
৩. হজরত উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু
(এমন সময়) হঠাৎ একটি লোক দরজা নড়াল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কে? সে বলল, আমি উসমান ইবনে আফফান। আমি বললাম, একটু থামুন।
তারপর আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর কাছে এসে তাঁর সম্পর্কে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, ওকে অনুমতি দাও। আর জান্নাতের সুসংবাদ জানাও। তবে ওর জীবনে বিপর্যয় আছে।
আমি ফিরে এসে তাঁকে বললাম, ‘প্রবেশ করুন। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপনাকে জান্নাতের সুসংবাদ জানিয়েছেন। তবে আপনার বিপর্যয় আছে।
সুতরাং তিনি সেখানে প্রবেশ করে দেখলেন যে, কুয়ার এক পাড় পূর্ণ হয়েছে। ফলে তিনি তাঁদের সামনের অপর পাড়ে গিয়ে বসে গেলেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
৪. ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলি বিন আবি তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু। আর অবশিষ্ট হলেন-
৫. হজরত তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু
৬. হজরত যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু
৭. হজরত আব্দুর রহমান বিন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু
৮, হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু
৯. হজরত সাঈদ বিন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও
১০. হজরত আবু উবাইদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু।
এ ছাড়াও যারা দুনিয়াতে থেকেই বিভিন্ন সময় প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে জান্নাতি বলে ঘোষণা পেয়েছেন; তারা হলেন-
১১। শহীদগণের সর্দার হজরত হামযাহ বিন আব্দিল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু।’ (জামে)
১২. হজরত জাফর বিন আবি তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু । (তিরমিজি, আবু ইয়ালা, মুসতাদরাকে হাকেম)
১৩. হজরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহু। (মুসনাদে আহমাদ, তাবারানি, মুসতাদরাকে হাকেম)
১৪. হজরত যায়েদ বিন হারেসাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু। (জামে)
১৫. হজরত যায়েদ বিন আমর বিন নুফাইল রাদিয়াল্লাহু আনহু। (জামে)
১৬. হজরত হারেসাহ বিন নুমান রাদিয়াল্লাহু আনহু। (তিরমিজি, মুসতাদরাকে হাকেম)
১৭. হজরত বিলাল বিন রাবাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবি বলেন-
একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘হে বিলাল! আমাকে সর্বাধিক আশাপ্রদ আমল বল, যা তুমি ইসলাম গ্রহণের পর বাস্তবায়িত করেছ। কেননা, আমি (মিরাজের রাতে) জান্নাতের মধ্যে আমার সম্মুখে তোমার জুতার শব্দ শুনেছি।’
হজরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমার দৃষ্টিতে এর চেয়ে বেশি আশাপ্রদ এমন কোনো আমল করিনি যে, আমি যখনই রাত-দিনের মধ্যে যে কোন সময় পবিত্রতা অর্জন (অজু, গোসল বা তায়াম্মুম) করেছি, তখনই ততটুকু নামায পড়ি, যতটুকু নামাজ পড়া আমার ভাগ্যে লিখিত ছির।’ (বুখারি ও মুসলিম)
১৮. হজরত আবুদ দাহদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু। ইনি খেজুরের গোটা বাগান দান করেছিলেন। তার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাকে বলেছিলেন, ‘আবু দাহদার নিমিত্তে জান্নাতে কত বিশাল খেজুর গাছ (ও খেজুর) রয়েছে!’ (মুসনাদে আহমদ, মুসতাদরাকে হাকেম)
১৯. হজরত অরাহ বিন নাওফাল রাদিয়াল্লাহু আনহু। (মুসতাদরাকে হাকেম, জামে)
দুনিয়ায় থাকতেই তাঁরা পেয়েছিলেন জান্নাতের সুসংবাদ। যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে দেখেই আমল করেছিলেন। আর পেয়েছিলেন জান্নাতের সুসংবাদ।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া আদর্শ বাস্তবায়ন করা। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়া। যারাই কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়তে সক্ষম হবে। তাদের জন্য জান্নাত সুনিশ্চিত।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম