উচ্চারণসহ সুরা ‘আন-নাসর’-এর আমল ও শিক্ষা
তিন আয়াতে সমৃদ্ধ মহা সুসংবাদ ইসলামের আসন্ন বিজয়ের ঘোষণা ‘সুরা আন-নাসর’। এ সুরায় শুধু ইসলামের বিজয়ের সুসংবাদই আসেনি বরং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও ক্ষমা প্রার্থনার দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। কোরআনুল কারিমের ১১০ নং সুরায় রয়েছে মানুষের জীবনের প্রতিটি পদে পদে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও আমল।
অর্থ ও উচ্চারণসহ সুরা আন-নাসর
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ
‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
اِذَا جَآءَ نَصۡرُ اللّٰهِ وَ الۡفَتۡحُ
ইজা ঝাআ নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতহ্
যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে।
وَ رَاَیۡتَ النَّاسَ یَدۡخُلُوۡنَ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰهِ اَفۡوَاجًا
ওয়া রাআইতান্নাসা ইয়াদখুলুনা ফি দ্বীনিল্লাহি আফওয়াঝা
আর আপনি দেখবেন মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে (জীবন ব্যবস্থা ইসলামে) প্রবেশ করছে।
فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ وَ اسۡتَغۡفِرۡهُ اِنَّهٗ کَانَ تَوَّابًا
ফাসাব্বিহ বিহামদি রাব্বিকা ওয়াসতাগফিরহু ইন্নাহু কানা তাওয়্যাবা
সুতরাং আপনি আপনার প্রভুর প্রশংসা পবিত্রতা পাঠ করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন; নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী। (মাখরাজসহ বিশুদ্ধ উচ্চারণে সুরাটি শিখে নেওয়া জরুরি )
সুরার মূল বক্তব্য
যে কোনো বিজয়ের জন্য আল্লাহর সাহায্যের বিকল্প নেই। সে কারণেই মানুষকে অনন্ত কালের জন্য এ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, যে কোনো বিজয় বা সফলতার জন্য আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। তবে তিনি দান করবেন বিজয় বা সফলতা। আর সাহায্য চাইতে হবে, আল্লাহ প্রশংসা, পবিত্রতা ঘোষণা এবং তাওবাহ-ইসতেগফারের মাধ্যমে। যা বাস্তবায়িত হয়েছে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে।
সুরার বৈশিষ্ট্য ও আমল
মানুষের জীবনে সুরাটির বৈশিষ্ট্য ও আমল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুরাটি নাজিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলব্দি করেছিলেন- এটিই তাঁর উপর নাজিল হওয়া বিদায়ী সুরা। তাইতো তিনি বিদায় হজের ভাষণ দিতে যাওয়ার জন্য কোসওয়া নামক উষ্ট্রী প্রস্তুত করার কথা বলেছিলেন। এর তিনি এ উষ্ট্রীতে চড়েই বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন।
১. হজের ভাষণে প্রিয় নবির বিদায়ের ইঙ্গিত
শায়খে আকবর আল্লামা মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি বলেন, ‘যখন সুরা আন-নাসর নাজিল হয়, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফার ময়দানে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ঐতিহাসিক এ ভাষণে তিনি একথাও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাঁর এক বান্দাকে দুনিয়া-পরকালের যে কোনো একটি পছন্দ করার সুযোগ দান করেছেন। তখন ওই বান্দা আল্লাহর সাক্ষাত পছন্দ করেছে। এ বক্তব্য শুনেই হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু উপলব্দি করলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজের ব্যাপারেই এ কথা বলেছেন এবং তাঁর বিদায় আসন্ন।
২. ইসলামের বিজয়ে ঘোষণা
আল্লাহ তাআলা সুরা আন-নাসরে ইসলামের বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। জানিয়েছেন যে, অচিরেই মানুষ দলে দলে ইসলামের জীবন ব্যবস্থায় শামিল হবে। ছোট্ট দুইটি আয়াতে এ ঘোষণা দেওয়া হলেও এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনেক বেশি। মক্কা বিজয়ে দিন প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন-
‘এটি সেই বিজয়! আমার পরওয়াদেগার যে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি সুরা আন-নাসর তেলাওয়াত করেন।’
৩. ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য মক্কা বিজয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময় আরব জাহানের অন্যসব ব্যক্তিরা হক ও বাতিলের ফয়সালার অপেক্ষা করছিল। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে হক প্রতিষ্ঠিত হলো, উদ্ভাসিত হলো আর বাতিল, কুফর ও জুলমত বিদায় নিলো। তখন আরবের অন্যান্য ব্যক্তিরাও ইসলাম গ্রহণের জন্য হাজির হতে থাকে। আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করে সেই সুসংবাদই দিয়েছেন প্রিয়নবিসহ বিশ্ববাসীকে-
وَ رَاَیۡتَ النَّاسَ یَدۡخُلُوۡنَ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰهِ اَفۡوَاجًا
আর (অচিরেই) আপনি দেখবেন মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে (জীবন ব্যবস্থা ইসলামে) প্রবেশ করছে।
৪. এ সুরার শেষ আয়াতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও আমল। যে আমলের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। এখানে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনে প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণার পাশাপাশি তাঁরই কাছে দুনিয়ার যাবতীয় অযোগ্যতা থেকে তাওবাহ-ইসতেগফারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বান্দার এসব কৃতজ্ঞতা ও তাওবা-ইসতেগফার গ্রহণ করা হবে বলেও আশ্বস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ وَ اسۡتَغۡفِرۡهُ اِنَّهٗ کَانَ تَوَّابًا
সুতরাং আপনি আপনার প্রভুর প্রশংসা পবিত্রতা পাঠ করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন; নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী।
মনে রাখা জরুরি
দুনিয়া ও পরকালের সফলতা ও বিজয় লাভে আল্লাহর রহমতের বিকল্প নেই। কেননা আমল-ইবাদত দ্বারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা পাওয়ার আশা খুবই কম। তাঁর রহমতেরই ক্ষমার দরজা খোলা থাকবে। হাদিসে পাকে প্রিয় নবি ঘোষণা করেন-
‘তোমাদের কেউ তাঁর আমলের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। সাহাবাগণ জানতে চাইলেন, আপনিও পারবেন না? প্রিয় নবি বললেন, ‘না’, যদি না আল্লাহ তাআলা তার রহমতের দ্বারা আবৃত করেন।’
এ সুরার বিশেষ শিক্ষা ও আমল
আল্লাহ তাআলা ঘোষিত এ বিজয়ের সুসংবাদে আনন্দ-উৎসবের কোনো ঘোষণা এ সুরায় আসেনি। বরং এ বিজয়ের ফলে মহান আল্লাহ মুমিন বান্দাকে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছেন। আর কোনো বিজয় আসলে এমনটি করাই শ্রেয়। আর এটিই নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুমহান আদর্শ। এ আদর্শ প্রতিষ্ঠিত থাকলে বিজয়ও থাকবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
১. প্রশংসা, পবিত্রতা ও কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন
فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ : সুতরাং আপনি আপনার প্রভুর প্রশংসা পবিত্রতা পাঠ করুন।
মক্কা বিজয়ের পর প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল ছিল এমন-
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় প্রিয়নবির বিনয় ও কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের বিষয়টি ফুটে ওঠেছে এভাবে-
‘মক্কায় প্রবেশ করার সময় প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উষ্ট্রের পিঠে আরোহী থাকা অবস্থায় আল্লাহর দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়েন। এ দৃশ্য ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য চিরস্মরণীয় ও অনুকরণীয়।’
২. ক্ষমা প্রার্থনা
وَ اسۡتَغۡفِرۡهُ : আর তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।
এ নির্দেশের কারণেই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনভর তাওবাহ-ইসতেগফার করতেন। হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন ৭০ থেকে ১০০ বার পর্যন্ত তাওবাহ করেছেন।
যারা আল্লাহ প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাদের জন্যই রয়েছে মহান প্রভুর ক্ষমা। যে ঘোষণা এসেছে এ সুরার সর্বশেষ অংশে-
اِنَّهٗ کَانَ تَوَّابًا: নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুরা আন-নাসরের শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। বিজয় ও খুশির সংবাদে অতি আনন্দে উৎফুল্ল না হয়ে আল্লাহর প্রশংসা, পবিত্রতা ও ক্ষমা প্রার্থনার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মোতাবেক জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস