সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ গুনাহ থেকে ক্ষমার আমল
মোহাম্মদ হাসিব উল্লাহ
ইসলামি শরিয়তে দুটি নির্দিষ্ট বিধান (حلال) বৈধ এবং (حرام) অবৈধ বা নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে হারাম কাজে লিপ্ত ব্যক্তির উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এবং তার আমলনামায় গুনাহ লেখা হয়। আফসোস! সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে জীবন চলার পথে মনের অজান্তে প্রতিনিয়ত আমরা কত গুনাহই না করে থাকি। এসব গুনাহ থেকে মুক্তির উপায় ক্ষমা প্রার্থনা।
রূপক অর্থে কারো গুনাহের পরিমাণ পাহাড় সমান, আবার কারো সমুদ্র কিংবা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হলেও কোনো বান্দা যখন চোখের পানি ছেড়ে ক্ষমা পাওয়ার আশায় অনুতপ্ত হয়, প্রার্থনা করে; তখন আল্লাহ তাআলা সব অসন্তুষ্টি ভুলে গিয়ে বান্দার প্রতি দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শন করে রহমতের চাদরে আবৃত করেন। কারণ আল্লাহ তাআলা (رحيم) দয়ালু ও (غفور) ক্ষমাশীল। কোরআনের ভাষায়-
وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
‘আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩১)
ক্ষমা ও দয়া মহান আল্লাহর অনন্য গুণ। তিনি সৃষ্টির প্রতি দয়াশীল ও ক্ষমাশীল। আল্লাহ তাআলা নিজেকে কোরআনের ১১৫ স্থানে (رحيم) দয়াশীল এবং ৯১ স্থানে (غفور) ক্ষমাশীল দাবি করে এ গুণের প্রমাণ দিয়েছেন।
গুনাহ করার পর আল্লাহর ক্ষমা পেতে ভয় ও আশা নিয়ে তাকে ডাকার কথা বলেছেন স্বয়ং আল্লাহ। এ আয়াতে তার দয়া নেক আমলকারীদের কাছাকাছি বলেও ঘোষণা করেছেন এভাবে-
وَ لَا تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ بَعۡدَ اِصۡلَاحِهَا وَ ادۡعُوۡهُ خَوۡفًا وَّ طَمَعًا ؕ اِنَّ رَحۡمَتَ اللّٰهِ قَرِیۡبٌ مِّنَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ
‘আর তোমরা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না তার সংশোধনের পর এবং তাঁকে ডাক ভয় ও আশা নিয়ে। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের কাছাকাছি।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৫৬)
এ আয়াতে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আল্লাহ তাআলা তার রহমত তথা দয়ার সঙ্গে (بعيد) দূরবর্তী শব্দ ব্যবহার না করে (قريب) কাছাকাছি শব্দ ব্যবহার করে বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। এতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, বান্দা শত গুনাহ করলেও বান্দার জন্য আল্লাহর ক্ষমার দরজা উন্মুক্ত।
মনে রাখতে হবে
আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল। তার দয়া একেবারেই নিকটে; এমন চিন্তা থেকে একই গুনাহ বার বার করে গেলে চলবে না। গুনাহের পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া যাবে না। কারণ কোনো বান্দা যদি সব ধরনের গুনাহের কাজ থেকে বিরত থেকে সব সময় এক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলে; তবে ওই বান্দা মহান আল্লাহর রহমতের কাছাকাছি এবং রহমত পেয়ে ধন্য হবে।
এমনকি মহান আল্লাহ তাআলার কাছে কেমন বাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, সে সম্পর্কেও পবিত্র কোরআনে অনেক আয়াত তা তুলে ধরা হয়েছে। সেসব ক্ষমার কিছু আহ্বান-
১. رَبِّ اِنِّیۡ ظَلَمۡتُ نَفۡسِیۡ فَاغۡفِرۡ لِیۡ
উচ্চারণ : ‘রাব্বি ইন্নি জালামতু নাফসি ফাগফিরলি’
অর্থ : ‘হে আমার প্রভু! নিশ্চয়ই আমি নিজের উপর জুলুম করেছি, অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৬)
২. رَبَّنَا ظَلَمۡنَاۤ اَنۡفُسَنَا وَ اِنۡ لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَ تَرۡحَمۡنَا لَنَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ
অর্থ : ‘রাব্বানা জালামনা আংফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।’
অর্থ : ‘হে আমাদের রব, আমরা নিজদের উপর যুলম করেছি। আর যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদেরকে দয়া না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’
এভাবে কোরআনুল কারিমের অসংখ্য আয়াতে মহান আল্লাহ ক্ষমা প্রাথর্নার উপায় তুলে ধরেছেন। হাদিসে পাকেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষমা প্রার্থনা অনেক দোয়া ও আমলের কথা উল্লেখ করেছেন। যার মাধ্যমে একজন মুসলিম সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ গুনাহ থেকে ক্ষমা পেতে সক্ষম। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-
১. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন একশত বার ‘سبحان الله وبحمده’ (সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী) বলবে, তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হবে; যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়।’ (বুখারি)
২. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজের শেষে ‘سبحان الله’ (সুবহানাল্লাহ) তাসবিহ ৩৩ বার ‘الحمد لله’ (আলহামদুলিল্লাহ) তাহমিদ ৩৩ বার এবং ‘الله أكبر’ (আল্লাহু আকবার) তাকবির ৩৩ বার পড়বে। আর এভাবে নিরানব্বই বার হওয়ার পর শততম পূর্ণ করতে বলবে-
لَا إلَهَ إلاَّ اللَّهُ وَحْدهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ، ولَهُ الحمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণ : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির।’
অর্থ : ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই। তিনি একক ও তাঁর কোনো অংশীদার নেই। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র তিনিই। সব প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য। তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’
তাহলে তার গুনাহসমূহ সমুদ্রের ফেনারাশির মতো অসংখ্য হলেও ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (মুসলিম)
৩. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সকালে (ফজরের নামাজের পর) ‘سُبْحَانَ الله’ (সুবহানাল্লাহ) ১০০ বার এবং ‘لَا اِلَهَ إلَّا الله’ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ১০০ বার বলবে; তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যদিও তা সমুদ্রের ফেনা সমান হয়।’ (নাসাঈ)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের ঘোষণায়ও প্রমাণিত যে, খুব কম সময়ে এবং সহজ উচ্চারণে তাসবিহ, তাহলিল, তাহমিদ ও তাওহিদের কালেমার ঘোষণায় মহান আল্লাহ বান্দার সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ গুনাহও ক্ষমা করে দেবেন। যে আমলগুলো ব্যক্তি জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি অর্জন মুহূর্তেই সম্ভব।
এছাড়াও কোনো বান্দা গুনাহ করলেও আল্লাহর পক্ষ থেকে সব সময় যে ক্ষমার দরজা উন্মুক্ত; তাও কোরআন-সুন্নাহর ঘোষণায় প্রমাণিত।
তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, নিজে যেমন এ আমলগুলো করে গুনাহ থেকে নিজেদের ক্ষমা পাওয়ার চেষ্টা করা ঠিক তেমনি অন্যদেরকে এ আমলের প্রতি উৎসাহিত করতে তা জানানোর প্রতিযোগিতা করা জরুরি। যেভাবে ঘোষণা করেছেন মহান আল্লাহ-
فَاسۡتَبِقُوا الۡخَیۡرٰتِ অর্থাৎ ‘তোমরা সৎকাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৪৮)
অতএব সবার উচিত ইসলামি বিধি-বিধান মেনে চলার চেষ্টা করা। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার এবং কোরআন-সুন্নাহর নিয়মিত অধ্যয়ন করা। অন্যকে ইসলামি বিধান মেনে চলার, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার এবং কোরআন-সুন্নাহর অধ্যয়নে নিয়োজিত থাকার প্রতি উৎসাহিত করা। আল্লাহ তাআলা সবাইকে দোয়া, আমল ও সৎকাজে প্রতিযোগিতা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
এমএমএস/এএসএম