স্বামী মারা গেলে নাক-কান-হাতে গহনা পরা কি নিষিদ্ধ?
নারীদের স্বামী মারা গেলে নাকফুল, কানের দুল, হাতর চুড়ি বা কাকন খুলে ফেলা হয় কিংবা খুলে রাখতে বলা হয়। অঞ্চলভেদে মৃত স্বামীর দাফন-কাফনের চেয়ে স্ত্রীকে বিধবায় রূপান্তরের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়। স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নারীর জন্য এসব গহনা খোলা কি জরুরি? এ সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনা কী? স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর করণীয়ই বা কী?
স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর করণীয়
ইসলামিক স্কলারদের মতে, স্বামীর মৃত্যুতে নারীর ব্যবহৃত কোনো গহনা খোলা কিংবা গহনা ব্যবহার না করা বাধ্যতামূলক নয়। এ রকম কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাও ইসলাম দেয় না। বরং স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর জন্য করণীয় মুল বিষয় হলো- ৪ মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন করা। আর ৩ দিন শোক পালনের পাশাপাশি ইদ্দত পালনকালীন সময়ে সাজ-সজ্জা থেকে বিরত থাকা।
তাই নারীরা স্বামীর মৃত্যুর পর ৩দিন শোক পালন করবে। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী ৪ মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন করবে। অনেকে ৪০ দিন ইদ্দত পালনের কথা বলে থাকেন। না, ৪০ দিন নয় বরং ৪ মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন করতে হবে। আর ইদ্দত পালনকালীন পুরো সময়ে সাজ-সজ্জা থেকে নিজেকে বিরত রাখাও জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا ۖ فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا فَعَلْنَ فِي أَنفُسِهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
‘আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে যাবে, তখন সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা। তারপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে, তখন নিজের ব্যাপারে নীতি সঙ্গত ব্যবস্থা নিলে কোন পাপ নেই। আর তোমাদের যাবতীয় কাজের ব্যাপারেই আল্লাহর অবগতি রয়েছে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৩৪)
তবে শোক পালন ও সাজ-সজ্জা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা মানে এটি নয় যে, স্বামীর মৃত্যুর আগে থেকে ব্যবহৃত নাকফুল, কানের দুল, হাতের চুড়ি-কাকন কিংবা গলায় ব্যবহৃত গহনা খুলে ফেলতে হবে। আর এগুলো নাক-কান-গলা কিংবা হাতে থাকতে পারবে না। ইদ্দত পালন, শোক পালন ও সাজ-সজ্জা থেকে বিরত থাকা সম্পর্কে একাধিক হাদিসে এসেছে-
১. ইদ্দত-শোক পালনের নির্দেশ
হজরত উম্মে হাবিবাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী কোনো নারীর জন্য তার স্বামী ব্যতিত অন্য কারো মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি সময় হিদাদ (শোক করা ও সাজসজ্জা থেকে বিরত থাকা) বৈধ নয়। আর স্বামীর মৃত্যুতে (স্ত্রী) ৪ মাস ১০ দিন হিদাদ পালন করবে।’ (বুখাবি)
২. রঙিন পোশাক
হজরত উম্মে আতিয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো স্ত্রীর স্বামী ব্যতিত অন্য কারো মৃত্যুতে তিন দিনের অধিক শোক প্রকাশ করবে না। অবশ্য স্বামীর মৃত্যুতে ৪ মাস ১০ দিন শোক পালন করবে। আর এ সময় কোনো রঙিন কাপড় পরবে না। অবশ্য হালকা রংবিশিষ্ট পোশাক পরতে পারে। আর সুরমা ব্যবহার করবে না, এবং কোনরূপ সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করবে না। অবশ্য হায়েজ (মাসিক ঋতুস্রাব) থেকে পবিত্র হওয়ার পর সামান্য সুগন্ধি বস্তু ব্যবহার করতে পারে।’ (আবু দাউদ)
৩. সাজ-সজ্জা ও সুগন্ধি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা
হজরত উম্মে সালামা রাদয়িাল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে স্ত্রীর স্বামী মৃত্যুবরণ করে সে যেন ইদ্দতকালীন সময়ে রঙিন এবং কারুকার্যমণ্ডিত কাপড় ও অলংকার পরিধান না করে। আর সে যেন খিজাব ও সুরমা ব্যবহার না করে।’ (আবু দাউদ)
স্বামীর মৃত্যুর পর করণীয় ও ইদ্দত সংক্রান্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা কুরতুবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
الإحداد : ترك المرأة الزينة كلها من اللباس والطيب والحلي والكحل والخضاب بالحناء ما دامت في عدتها
হিদাদ পালনের অর্থ হলো- নারীরা তার ইদ্দতকালীন সময়ে সুগন্ধি, সুরমা, মেহেদি, গহনাসহ পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রে যাবতীয় সাজসজ্জা ত্যাগ করবে।’ (তাফসিরে কুরতুবি)
স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর গহনা ব্যবহারে স্বামীর কবর আজাব হয় কিংবা ছেলে সন্তানের আয়ু কমে যায় আবার স্বামী জীবিত থাকাকালীন সময়ে গহন না পরলে স্বামীর আয়ু কমে যায়; এসবই ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। এসব ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার থেকে বিরত থাকাও নারীর জন্য একান্ত জরুরি।
সুতরাং স্বামী মারা গেলেই নারীকে গহনা খুলে ফেলতে হবে এটিকে ইসলামের নির্দেশ মনে করে তা বাস্তবায়নকে আবশ্যক মনে না করা। বরং কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মোতাবেক ৪ মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন, শোক পালন ও সাজ-সজ্জা থেকে বিরত থাকাই হলো ইসলামের বিধান।
আল্লাহ তাআলা ইসলামের বিধান ও বিষয়গুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস