ইসলামে দাড়ি রাখার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ধর্ম ডেস্ক
ধর্ম ডেস্ক ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:১১ পিএম, ১২ জুলাই ২০২১

তোফায়েল আহমেদ রামীম

ইসলামী সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন দাড়ি। পুরুষের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক। দাড়ি রাখার মাধ্যমে পুরুষের মুখের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। দাড়ি শুধু পুরুষের বীরত্বের পরিচয়ই বহন করে না বরং ইহা আল্লাহর ভয়ের অন্যতম নিদর্শনও বটে। দাড়ি রাখা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বিশেষ সুন্নাত।

দাড়ি রাখা ব্যক্তিদের যে কেউ চাইলেই খারাপ কোনো কাজে লিপ্ত হতে পারে না। সে সবসময় ভালো দিকটিই খুঁজে। দাড়ি খারাপ কাজের প্রধান অন্তরায়। দাড়ি রাখার কারণে মনের অজান্তেই অনেক খারাপ ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে যায় মানুষ।

দাড়ি মানুষের ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। সমাজে সম্মানের আসনে জায়গা করে দেয় দাড়ি। নির্দ্বিধায় যে কাউকে সম্মানের পাত্র বানায়। দাড়ি মানুষকে পূণ্যবান ও শোকরগুজার বান্দায় পরিণতি করে দেয়। দাড়ি রাখা প্রিয় নবীজির একটি বিশেষ সুন্নাত।

ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে মুসলিম উম্মাহর কাছে সুন্নতের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সুন্দর ও সৌরভময় করতে হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা-মদিনার ৬৩ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে উম্মতকে দিয়েছেন সুন্দর ও উজ্জ্বলতম পথনির্দেশ। যা উম্মতে মুসলিমাহর কাছে সুন্নাত নামেই পরিচিত। তেমনি একটি সুন্নাত দাড়ি রাখা।

এটি ইসলামের বিশেষ চিহ্ন, অন্যতম নিদর্শন, নবি-রাসুলগণের তরিকা ও ইসলামী চিন্তা-চেতনার দিক থেকে দাড়ি রাখার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

আরবি ‘লিহইয়াহ’-এর বাংলা অর্থ হচ্ছে দাড়ি। এই শব্দটি লাহি বা চোয়াল থেকে আগত। চোয়াল তথা গালে গজানো চুলকেই মূলত দাড়ি বলা হয়। পুরুষদের মুখমন্ডলে দাড়ি রাখা মুসলমানদের এক গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন; যা তার মুসলমান হওয়ার অন্যতম একটি পরিচয় বহন করে। দাড়ি রাখা ফরজ, ওয়াজিব নাকি সুন্নত তা নিয়ে রয়েছে মতপার্থক্য থাকলেও তা যে বিশ্বনবিসহ সব নবি-রাসুলের সুন্নাত; তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ১০টি বিষয় সব নবি-রাসুলের সুন্নাত। তন্মধ্যে গোঁফ ছোট করা এবং দাড়ি লম্বা করা অন্যতম।’ (মুসলিম)

আবার দাড়ি রাখা যে ওয়াজিব বা আবশ্যক; তা এড়িয়ে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। কারণ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আল্লাহ ও তার রাসুল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী সে বিষয়ে না বলার ক্ষমতা নেই, যে আল্লাহ ও তার রাসুলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৩৬)

আল্লাহ তাআলা এ আয়াতের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এ দিক থেকে অনেকেই দাড়ি রাখাকে ওয়াজিব বা আবশ্যক বলেছেন।

অনেকে দাড়ি রাখাকে ফরজ দাবি করে থাকেন। তাই দাড়ি না রাখাকে অবহেলা করার কোনো অবকাশ নেই। কারণ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করতেন বা যা কিছু বলতেন তার সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল। এই মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘রাসুল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক, এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সুরা হাসর : আয়াত ৭)
এ আয়াতের আলোকে ইসলামিক স্কলারদের অনেকেই দাড়ি রাখাকে ফরজ সাব্যস্ত করেছেন।

দাড়ি কতটুকু লম্বা করতে হবে
দাড়ি কতটুকু লম্বা করতে হবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো হাদিস না থাকলেও দাড়িকে ছেড়ে দেওয়ার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে-
১. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা গোঁফ অধিক ছোট করবে এবং দাড়ি ছেড়ে দেবে।’
২. হাদিসের অন্য বর্ণনায় এসেছে-
হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের গোঁফ খাটো করতে এবং দাড়ি লম্বা করতে আদেশ করেছেন।’
তবে এক মুঠো পরিমাণ দাড়ি লম্বা রাখার ব্যাপারে অনেকে সমর্থন করলেও এ পরিমাণের ব্যাপারে হাদিস থেকে সরাসরি কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। তবে হজরত আবু হুরায়রা এমনটি করতেন মর্মে মুসান্নেফে ইবনে আবি শায়বার একটি হাদিসে তা উল্লেখ রয়েছে।

হজরত আবু হুরায়রা(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেক বর্ণিত আছে যে, তিনি দাড়ি হাতের মুঠোয় নিয়ে এর অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন।’ (ইবনে আবি শায়বা; ৮ম খন্ড)

দাড়ি মুণ্ডন বা শেভ করা নিষিদ্ধ
দাড়ি মুণ্ডন বা শেভ করা হাদিসের নিদের্শনার খেলাফ। পক্ষান্তরে তা ইয়াহুদি-খ্রিস্টান, মুশরিক ও অগ্নিপূজকদের বৈশিষ্ট্য। কেননা দাড়ির ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা হলো-
১. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা দাড়ি ছেড়ে দাও, গোঁফ ছোট করো, পাকা চুলে (কালো ছাড়া অন্য) খেযাব (মেহেদি) লাগাও এবং ইয়াহুদি ও নাসারাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না।’

২. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুশরিকদের বিরোধিতা কর, দাড়ি লম্বা কর, আর গোঁফ ছোট কর।’ (বুখারি ও মুসলিম)

৩. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইসলামের ফিৎরাত হলো জুমআর দিনে গোসল করা, মেসওয়াক করা, গোঁফ ছেটে ফেলা ও দাড়ি লম্বা করা। কেননা অগ্নিপূজকরা গোঁফ লম্বা করে ও দাড়ি ছেটে ফেলে, অতএব তোমরা তাদের বিরোধিতা করো, গোঁফ ছোট করো আর দাড়িকে প্রসারিত কর।

উপরোক্ত হাদিসের আলোকে প্রথমত ইয়াহুদি-খ্রিস্টান, মুশরিক-অগ্নিপূজকদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা যাবে না। দ্বিতীয় তাদের অনুকরণে দাড়ি ছোট বা মুণ্ডন করা যাবে না। হাদিসের নির্দেশনায় তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কাজ। বরং দাড়ি রাখার মাধ্যমে ইয়াহুদি, খ্রিস্টার, অগ্নিপূজক ও মুশরিকদের বিরোধিতা করা ঈমানের একান্ত দাবি।

দাড়ি রাখার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা
যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে দাড়ি নিয়ে গবেষণা চালানো হয়, যার ফল প্রকাশিত হয় ‘জার্নাল অব হসপিটাল ইনফেশন’ নামে এক ম্যাগাজিনে। গবেষণায় বলা হয়েছে যে-
‘দাড়ি রাখা ব্যক্তিদের চেয়ে দাড়ি কামানো ব্যক্তিদের ত্বকেই মেথিসিলিন-রেসিস্ট্যান্ট স্ট্যাফ অরিয়াস বলে যে জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ সেটি তিন গুণ বেশী মাত্রায় পাওয়া গেছে।’
গবেষকরা জানিয়েছেন, ‘দাড়ি কামাতে গিয়ে মুখের চামড়ায় যে ঘষা লাগে তা ব্যাকটেরিয়া বাসা বাধার জন্য আদর্শ পরিবেশ, অন্যদিকে দাড়ি মুখের ত্বকে ব্যাকটেরিয়ার এই সংক্রমণ ঠেকাতে সাহায্য করে।’

লন্ডনের গবেষক ডারম্যানটোলজিস্ট ড. অ্যাডাম রবার্ট এক গবেষণায় দেখেছেন, দাড়িতে এমন কিছু ‘মাইক্রোব’ থাকে; যা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে।

তিনি আরও বলেন, ‘মুখের ত্বক দাড়ি দিয়ে ঢাকা থাকার ফলে সূর্যের আলোর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হয়। এতে ত্বকের ক্ষতি কম হয়, তাই ত্বকে বয়সের চাপ পড়তে দেরি হয়।’

দাড়ির রাখার উপকারিতা
১.দাড়ি রাখা সুন্নাত ও সাওয়াবের কাজ।
২. ইয়াহুদি-খ্রিস্টান, অগ্নিপূজক ও মুশরিকদের অনুসরণমুক্ত হওয়া।
৩. দাড়ির অস্তিত্ব যৌন শক্তিকে বৃদ্ধি করে’
৪. পাইরিয়ার মতো মারাত্মক রোগের জীবাণু থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৫. শারীরিক সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়।
৬. ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে চোয়াল ও চামড়া নিরাপদ থাকে।

দাড়ির না রাখার ক্ষতি
১. সুন্নাতের বিরোধিতা।
২. ইয়াহুদি-খ্রিস্টান, অগ্নিপূজক ও মুশরিকদের অনুসরণ।
৩. দাড়িতে ক্ষুর বা ব্লেড ব্যবহারের কারণে চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়ে যায়।
৪. মুখমন্ডলের চামড়া শক্ত হয়ে যায়।
৫. ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে চোয়াল ও চামড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মুসলিম উম্মাহর সতর্কতা জরুরি
পয়গাম্বর হজরত লুত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় দাড়ি না রাখা এবং গোঁফ লম্বা করার কারণে ধ্বংস হয়েছিল। হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, যে ১০টি করণে হজরত লুত আলাইহিস সালামের সম্প্রাদায় ধ্বংস হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যমত একটি কারণ ছিল- দাড়ি না রাখা এবং গোঁফ লম্বা রাখা।’ (নাউজুবিল্লাহ!)

পরিশেষে...
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, দাড়ি রাখার মাধ্যমে আল্লাহ ও তার প্রিয় রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। এ দাড়িই কেয়ামতের দিন অন্ধকারের সময় নুরে ঝলকাতে থাকবে। ঈমান ও আমল ঠিক থাকলে দাড়ি রাখা ব্যক্তিদের হাসর হবে নবি-রাসুলগণের সাথে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দাড়ি রাখার মাধ্যমে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। দাড়ি রাখার উপকারিতা পাওয়া ও ক্ষতি থেকে বাঁচার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : তোফায়েল আহমেদ রামীম, শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা কলেজ।

এমএমএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।