পণ্য মজুত রেখে বেশি দামে বিক্রি করা কি বৈধ?

ধর্ম ডেস্ক
ধর্ম ডেস্ক ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৫৩ পিএম, ০৩ জুন ২০২১

ব্যবসা করা হালাল বা বৈধ। কেননা আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন। কিন্তু ব্যবসার উদ্দেশ্যে পণ্য মজুদ করা বৈধ কিনা। এ সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনাই বা কী?

মূল বিষয়টি হলো
কোনো ব্যবসায়ী যে কোনো পণ্যের সহজলভ্য মৌসুমে ব্যবসার উদ্দেশ্যে তা কিনে রেখেছেন; যখন ওই পণ্যের দাম বাড়বে তখন এটি বিক্রি করবেন। এভাবে কোনো পণ্য মজুত করে রাখা এবং পরবর্তী বেশি দাকে বিক্রি করা বৈধ কিনা?

এ বিষয়টির সমাধান নির্ভর করবে- পণ্য কিনে মজুত রাখা ব্যক্তির নিয়তের ওপর। পণ্য মজুত করে রাখার পেছনে ওই ব্যবসায়ীর নিয়ত কী? এবং বাজারে এ পণ্যের প্রভাব কেমন তৈরি হচ্ছে সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

মনে রাখা জরুরি
মৌসুমে পণ্য কিনে মজুত করে রাখা একটি ব্যবসা। আর ব্যবসাকে আল্লাহ তাআলা হালাল বা বৈধ করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত জীবিকাকে সর্বোত্তম বলেছেন।

সুতরং স্বাভাবিকভাবে পণ্য মজুত করে ব্যবসা-বানিজ্যের উদ্দেশ্যে বেঁচা-কেনা করা সাধারণত হালাল বা বৈধ। ব্যবসার ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি হলো মৌসুমী পণ্য কিনে রেখে বেচা-কেনা করা যাবে।

এটি তখন জায়েজ হবে না…
ব্যবসায়ী যখন মৌসুমী পণ্য এই নিয়তে কিনেছেন যে, তিনি জানেন বাজারে এর সংকট তৈরি হবে। বাজারে সংকট তৈরির উদ্দেশ্যেই তিনি পণ্য কিনে মজুত করবেন; আর বাজারে সংকট তৈরি হলে এ পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে আর এর দামও বাড়বে অনেক বেশি। তখন তিনি কম কম করে বেশি দামে বাজারে তা বিক্রি করবেন। এভাবে বাজারে সংকট তৈরির উদ্দেশ্যে পণ্য মজুত করা হয় তবে তা বৈধ হবে না। কারণ তখন এটি ব্যবসায় অন্তর্ভূক্ত হবে না। ওই ব্যক্তি অপরাধী ও কবিরাহ গোনাহগার হবেন। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মজুদদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায় তাহলে চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর যদি মূল্য বেড়ে যায় তাহলে আনন্দিত হয়।’ (মিশকাত)
এভাবে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় হালাল খাদ্যসামগ্রী গুদামজাত করে কিংবা মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইহতিকার’ বা মজুতদারি বলা হয়। রাসুলে আরাবি মজুদদার ব্যক্তিকে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

ব্যবসার ছদ্মছায়ায় পণ্য মজুতের পরিণতি
অস্বাভাবিক হারে মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পণ্য মজুত করা বা সংকট তৈরি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার নাম ব্যবসা নয়। বরং এটা ইহতিকার বা মজুতদারি। এটি শুধু মারাত্মক ঘৃনিত কাজই নয় বরং তা অত্যন্ত জঘন্যতম পাপ এবং শোষণও বটে। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী।’ (মিশকাত)
অসাধু ব্যবসায়ীদের এ জঘন্য কাজ কখনো ব্যবসা নয়; বরং এটি মানুষের প্রতি শোষণ ও জুলুম ও নির্যাতন। যে সব অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করেন, তাদের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে অনেক সতর্কবার্তা। তাহলো-
১. ‘যে ব্যক্তি বাজারে পণ্যের অভাবের সময় পণ্য মজুদ করে রাখে সে বড় পাপী।’ (মুসলিম)
২. ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।’
৩. ‘বিভ্রান্ত লোকই শুধু মজুদদারী করে।’ (ইবনে মাজাহ)
৪. ‘যে মুসলিম সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্য চল্লিশ দিন যাবত মজুদ করে রাখবে আল্লাহ তাকে দূরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দিবেন।’ (ইবনে মাজাহ)
৫. ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ করবে তার সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।’
৬. ‘মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট।’ (মিশকাত)

ব্যবসার নামে মজুতদারের প্রতি দায়িত্বশীলদের করণীয়
যারা অসাধু উপায়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করবে তার কাছ থেকে রাষ্ট্র কিংবা প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা ওই ব্যক্তির কাছ থেকে পণ্যগুলো উদ্ধার করে তা বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। ওই ব্যক্তিকে তা বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য করাই দায়িত্বশীলদের সংকটকালীন সময়ে প্রধান কর্তব্য। যাতে মানুষের কষ্ট কমে।

ব্যবসায়ীদের জন্য যে মজুত গোনাহের কারণ হবে না…
কোনো পণ্য উৎপাদনের মৌসুমে ওই জিনিসের দাম কম থাকে। কিছু দিন অতিবাহিত হলে বা উৎপাদনের সময় অতিবাহিত হলে স্বাভাবিকভাবেই ওই পণ্যের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। মানুষের নিত্য পণ্যের মধ্যে- আলু, পেয়াজ, রসুন, হলুদ, চাল, ডাল, ভুট্টা, শরিষা, ধনিয়া, গম, ধান ইত্যাদি মৌসুমী সময়ে দাম কম থাকে।
মৌসুম চলে গেলে কিছুটা দাম বাড়লে কিংবা সংকট তৈরি না হলে ওইসব পণ্য বিক্রি করে মুনাফা নেওয়া অবৈধ নয়। বরং এভাবে পণ্য কিনে মজুত করে ব্যবসা করায় কোনো দোষ নেই। এভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সবার জন্য বৈধ।

কারণ এভাবে পন্য কিনে মজুত করায় যেমন লাভের সম্ভাবনা আছে, আবার এসব পণ্যের মজুত করার পরও লোকসানের সম্ভাবনা থাকে। কেননা মৌসুমে যে পরিমাণ পণ্য কেনা হবে, মৌসুম চলে গেলে সে পণ্যগুলো কিছুটা ঘাটতি হবে, ওজনে কমে যাবে। আবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। আবার এসব পণ্যের বেশি ফলন হলে সেক্ষেত্রেও দাম কমে যেতে পারে। সে কারণেই পণ্যের কৃত্রিম সংকটের উদ্দেশ্য না থাকলে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এভাবে স্বাভাবিকভাবে পণ্য মজুত করে তা পরে বিক্রি করা বৈধ।

সুতরাং যেসব ব্যবসায়ী পণ্য মজুত করেন, তাদেরকে অবশ্যই ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বাজারের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। যাতে পণ্য মজুত করার কারণে যেন কারো কষ্টের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণে ব্যবসা-বাণিজ্য করার তাওফিক দান করুন। অবৈধভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। অবৈধ মজুতদারী থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে কবিরা গোনাহ ও অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।