বাংলার প্রথম মুহাদ্দিস : শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা
মওলবি আশরাফ
কালের প্রবাহে ভগ্নপ্রায় ছোট ভবনটি দেবে গেছে মাটির গর্ভে; লোকে বলে, আজ থেকে সাড়ে সাতশ বছর আগে জিকির করতে করতে এখান থেকে মাওলার সান্নিধ্যে যাত্রা করেন তিনি। সাথে নিয়ে যান ভারত-দুহিতা এই বাংলা ভূখণ্ডের তদানীন্তন রাজধানী সোনারগাঁয় ইলমচর্চার সূতিকাগার প্রতিষ্ঠার সগৌরব ইতিহাস।
শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। তিনি বাংলায় আগমনকারী ইলমে হাদিসের প্রথম মুহাদ্দিস। তিনি জন্মেছিলেন বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারায়। শিক্ষা লাভ করেছিলেন খুরাসানে। খুব কম বয়সেই তিনি ধর্মপ্রবণ ও তীব্র জ্ঞানাকাঙ্ক্ষী হিশেবে বিখ্যাত হয়ে পড়েন। একদিকে হাদিস ও ফিকহ অন্যদিকে রসায়ন ও প্রকৃতিবিজ্ঞানে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন।
জ্ঞানগত অগ্রসূরী ইমাম ইসমাইল বুখারি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতো তাকেও ধারণ করতে পারেনি বুখারার লোকজন। তাই আনুমানিক ১২৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে মামলুক সালতানাতের রাজধানী দিল্লিতে হিজরত করে চলে আসেন।
তিনি ছোট্ট এক মসজিদের পাশে অবস্থান নিয়েছিলেন। কোনো বাসভবন ছিল না তাঁর, খুপরি ঘরে থাকতেন। বছরের পর বছর ইতেকাফে রত থাকতেন আর ইলম পিপাসুদের মাঝে রুহানি মধু বিলাতেন তিনি।
তিনি সপ্তাহে একদিন ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে আমজনতার উদ্দেশে কথা বলতেন। এ দিনটিতে সারা দিল্লি ভেঙে পড়ত তাঁর মহল্লায়। রাজা, রাজপুত্র থেকে নিয়ে ভিখারি, সর্বহারা— সকলেই ধূলির আসনে সাম্যের জলসায় বসে যেতো।
তিনি রাজাদেরও ভুল ধরিয়ে দিতেন; তাদের করণীয় নির্দেশ করতেন। আমির-নবাবদের ইচ্ছাবিলাসের সমালোচনা করতেন; দেখাতেন সুপথ। কারো ভালোলাগা-মন্দলাগার কোনো পরোয়াই ছিল না তাঁর।
দিল্লিতে বসবাসের কয়েক বছরের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেন ভারতের শীর্ষ আলেমে দ্বীন। তাঁর জনপ্রিয়তা ও প্রভাবশালী বক্তব্যের প্রতাপ এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে, এক ঘোষণায় তিনি দিল্লির রাজসিংহাসন গুঁড়িয়ে দিতে পারতেন। অথচ তিনি ছিলেন একেবারেই দুনিয়াবিমুখ— ‘জাহেদ’।
মামলুক সুলতান প্রথম নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (রাজত্বকাল ১২৪৬ - ১২৬৫) তাঁর প্রতি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী উলুঘ খান বলবন (রাজত্বকাল ১২৬৬ - ১২৮৭) সুলতান গিয়াসুদ্দিন নাম ধারণ করে রাজ্য গ্রহণ করলে তিনি বিত্তহীন দ্বীন এই ফকিরের সর্বব্যাপী প্রতাপকে সাম্রাজ্যের জন্য ঝুঁকি মনে করে আতঙ্কিত হলেন। অতঃপর তাঁকে কৌশলে নির্দেশ করলেন দিল্লি ত্যাগের।
সুলতান গিয়াসুদ্দিনের নির্দেশে বিনাবাক্য ব্যয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন নিরুদ্দেশে। হাজার হাজার অনুসারী তাঁর পিছু নিল; ছদ্মবেশী সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনও সামিল হলেন সে কাফেলায়।
একসময় উত্তেজিত অনুসারীগণ তাঁর চারপাশে ভিড় করল। ছদ্মবেশধারী সুলতান তাদের হয়ে আওয়াজ তুললেন, ‘আপনি আদেশ দিন, আজই আমরা আগুন লাগিয়ে দিব বলবনের সিংহাসনে।
অনুসারীগণ সমস্বরে চীৎকার দিয়ে বলল, ‘তা-ই হবে! আমরা আপনাকে ক্ষমতায় বসাব, অথবা আপনি যাঁকে চান তাঁকে।’
এবার আবু তাওয়ামা সুস্থির, ধীরোদাত্ত স্বরে বললেন- ‘থামো! আমি আল্লাহর এক ইচ্ছা থেকে অন্য ইচ্ছার দিকে যাচ্ছি।’
‘আমি, আমরা এমন নই; যাদেরকে আঘাত করলে প্রতিশোধ নেয়।...
ব্যক্তিগত হারানো বলতে আমাদের হারানোর কিছুই নেই। আমাদের হারানো সেটাই, যেটা হারায় আমাদের জাতি।...
তোমরা বিদ্রোহ করতে চাও?
হ্যাঁ, বিদ্রোহ করো সেই চরিত্রের বিরুদ্ধে, যে চরিত্রের কারণে তোমরা এক আবু তাওয়ামার জন্য এক সাম্রাজ্যকে বিরান করতে চাও।...
আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ো না। উদ্বিগ্ন হও সেই ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে; যা তোমাদের ও তোমাদের শাসকদের দায়িত্বহীন করে রেখেছে।...
মুহাদ্দিস আবু তাওয়ামার ঘোষণা-
‘ক্ষমতা আমরা চাই না। যখন চাইতে থাকব, তখন আমরা আর আমরা থাকব না। ক্ষমতাকে সুপথে চালানোর চেষ্টা আমাদের। দিল্লিতে থাকতে এটা (রাজ্য) যেমন চলেছে, দূরে গেলেও চলবে। আমি চললাম। তোমরা ফিরে যাও। দিল্লি ও দিল্লির সুলতানের জন্য দোয়া থাকবে আমার।’
সুলতান গিয়াসুদ্দিনের প্রতিক্রিয়া
খোদাভীরু জাহেদের প্রকৃত অবয়ব নিজ চোখে দেখে ছদ্মবেশি সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন অপরাধবোধ আর লজ্জায় মাটির সাথে নুয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ছদ্মবেশ ত্যাগ করে সশ্রদ্ধ নিবেদন করলেন-
‘শায়খ! আমিই সুলতান বলবন। আমি অন্যায় করেছি। দিল্লি আপনার, ফিরে আসুন আমাদের মাঝে।’
মুহাদ্দিস আবু তাওয়ামা কিন্তু ফিরলেন না। তিনি সুলতান ও জনগণকে হিতোপদেশ দিয়ে বিদায় জানালেন, আর তিনি চললেন বাংলা অভিমুখে।
বাংলা প্রথম মুহাদ্দিস আবু তাওয়ামার আগমন
১২৭০ থেকে ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দের কোনো একসময়ে শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা সোনারগাঁয়ে (মোগড়াপাড়া দরগাবাড়ি প্রাঙ্গণে) উপনীত হন, এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সংকল্প করেন।
বাংলার সোনারগাঁ আসার পথে তিনি বিহারের মানের শহরে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি মাখদুমুল মুলক ইয়াহইয়া মানেরির সাথে পরিচিত হন এবং তাঁর পনের বছর বয়সী পুত্র শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরি শায়খের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে চান।
শায়খ আবু তাওয়ামা তাঁর ইলমের প্রতি তলব ও মেধার প্রখরতা দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। অতঃপর প্রিয় শিষ্য শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরিকে দিয়ে শুরু করেন ভারতভূমিতে ইলমে হাদিস চর্চার প্রথম বিদ্যাপীঠ। গড়ে তোলেন সমৃদ্ধ কুতুবখানা।
ইলমে হাদিসের শিক্ষা শুরু
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বিশ্বকোষ মতে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ থেকেই উপমহাদেশে প্রথম ইলমে হাদিসের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু হয়। শায়খ আবু তাওয়ামা এখানে বুখারি, মুসলিম ও মুসনাদে আবু ইয়ালার দরস প্রদান করতেন।
ইলমের মধু আহরণে মধুমক্ষিকাদল সুদূর বোখারা, কান্দাহার, খোরাসান, সিরিয়া, ইয়েমেন, বিহার ও দাক্ষিণাত্য থেকে ছুটে আসেন। ধারণা করা হয়, তখন এ বিদ্যাপীঠের ছাত্রসংখ্যা ছিল দশ হাজার।
ইলমে দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেকটি বিষয়ের ওপর এখানে শিক্ষা প্রদান করা হতো। অধিবিদ্যা, সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, নৌবিদ্যা, ভেষজশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, ভূগোলশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান কিংবা দর্শনশাস্ত্র— এহেন কোনো বিষয় ছিল না; যা এখানে পড়ানো হতো না।
সময়ের ব্যবধানে এটি কেবল বিদ্যাপীঠই থাকেনি, হয়ে উঠেছিল সমাজ-রাজনীতির শোধনাগার। তাঁর ছিল নিজস্ব নৌবাহিনী, প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য বাহিনী। ছাত্ররা ইলমচর্চার পাশাপাশি ছিল বাংলার জনগণের নিরাপত্তার আমানতদার। ‘বাংলার ধর্মজীবনের শুদ্ধি ও সুরক্ষা, সাংস্কৃতিক সচেতনতা, স্বাধীনতা ও জাতীয় সংহতি রক্ষা, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি, হানাদারদের প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে নির্ভরতার কেন্দ্র ছিল এই বিদ্যাপীঠ।
দীর্ঘ ২৩ বছর ইলমের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন মুহাদ্দিস শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। পাশাপাশি জনসাধারণের আত্মশুদ্ধির মানসে একটি খানকাও (আশ্রম) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দি তরিকার পীর।
মুহাদ্দিস আবু তাওয়ামা ‘মানজিলে মাকামাত’ নামে অধিবিদ্যা (তাসাওফ) সম্বন্ধে একটি কিতাব লিখেছিলেন বলে জানা যায়।
এ ছাড়াও সোনারগাঁ বিদ্যাপীঠে অবস্থানকালে শায়খ ছাত্রদের উদ্দেশে আইনশাস্ত্রবিষয়ক যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন, সেগুলোর সংকলন নিয়ে ফারসি ভাষায় রচিত ‘নামায়ে হক’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা আছে। কেউ কেউ তা ‘মসনবি বনামে হক’ নামে অভিহিত করেছেন।
গ্রন্থটি ১৮৮৫ খ্রিষ্টীয় সনে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) থেকে এবং ১৯১৩ অব্দে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। জানা যায়, শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার লিখিত পাণ্ডুলিপি ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে রক্ষিত আছে।
শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার পাঠদান ছিল উন্মুক্ত, তাতে প্রশাসক আলেম পর্যটক বিদেশি ও সাধারণ যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারতেন। খুব ভিড় জমতো তার ইলমি দারসের মাজলিসে। তাই একসময় তিনি একান্তে মাওলার স্মরণের জন্য জনসমাগম থেকে দূরে ‘আন্ধার কোঠায়’ চলে যান।
আনুমানিক ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে মাওলার নৈকট্যে রওয়ানা দেন। ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
শায়ক শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরির দায়িত্ব পালন
শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার ইন্তেকালের পর বিদ্যাপীঠের পরিচালক হন শায়খ শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরি। তিনি ছিলেন শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার প্রকৃত ভাবশিষ্য এবং তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা ও জ্ঞানতত্ত্বে পরিপক্বতা দেখে শায়খ তাঁর কাছে কণ্যাদান করেছিলেন।
শায়খ আবু তাওয়ামার নির্দেশনায় তিনি আধ্যাত্মিক দীক্ষাদানের অনুমতির জন্য গিয়েছিলেন ওলিকূল-শিরোমণি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সান্নিধ্যে। নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাঁর সাথে কতগুলো জটিল ধর্মতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর যথার্থ ও বিষদ বিশ্লেষণী উপস্থাপন নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে এতোটাই প্রীত করে যে, তিনি তাঁর সম্মানে এক থাল পান পেশ করেন। যা ভারতীয় সুফিদের ইতিহাসে অনুপম, নজিরবিহীন।
মানেরি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে চাইলে নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন— ‘এ তো ফিনিক্স পাখি, এঁকে আমাদের ফাঁদে ধরে রাখা যাবে না।’
এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরির এই পূর্ণতা শায়খ আবু তাওয়ামার সাহচর্যে, এই সোনারগাঁয়েই হয়েছিল। মানেরি কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তা নয়, সুন্নতের আলোকে জীবন পরিচালনায় নিজেই ছিলেন আদর্শ। তাঁর দৃঢ়তা ছিল পাহাড়সম। ছিলেন বিনয়ী ও নিবেদিতপ্রাণ।
শায়খ শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরি সবসময় নিজের অপূর্ণতা ও ত্রুটি তালাশ করতেন। মুরুব্বিদের থেকে নিরন্তর আলো গ্রহণে উৎসুক ছিলেন। তাঁর কথামালা ও লিখিত প্রতিটি চরণ প্রাজ্ঞতার তরঙ্গে উচ্ছ্বসিত।
‘হাদিস শিক্ষাদানে তিনি বুখারি, মুসলিম, জামে সগির, মুসনাদে আবি ইয়ালা, মাশারিকুল আনওয়ার, শরহে সাখাবি ও মিশকাতুল মাসাবিহকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাঁর ছাত্রদের অনেকেই ছিলেন ভারতবরেণ্য মুহাদ্দিস।
সোনারগাঁ মোগরাপাড়ায় প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে কয়েকজন উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তার নাম পাওয়া যায়, যাদের নামের শুরুতে পদবি হিশেবে যুক্ত ছিল মুহাদ্দিস শব্দটি। ধারণা করা হয়-
‘তাঁরা সবাই সরাসরি বা শিক্ষাপরম্পরায় শায়খ আবু তাওয়ামার ছাত্র ছিলেন। প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি প্রত্যেকেই হয়তো মাদরাসায় শিক্ষকতা ও হাদিস শিক্ষাদানে নিযুক্ত ছিলেন।’
ইবনে বতুতা তাঁর সফরনামায় শায়খ জালালুদ্দিনের (হজরত শাহজালাল) সাথে সাক্ষাৎ শেষে সোনারগাঁর উদ্দেশে রওনা করার কথা উল্লেখ করেন। তখন বাংলায় ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ’র রাজত্ব। তিনি দরবেশদের বিনা পয়সায় নদী পারাপার, খাদ্যের যোগান এবং তাঁরা কোনো শহরে প্রবেশ করলে অর্ধ দিনার প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয় এই প্রচলন শায়খ আবু তাওয়ামার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠের কারণেই শুরু হয়েছিল।
তাছাড়া ইবনে বতুতা সোনারগাঁকে উল্লেখ করেছেন সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য নগরী। আমরা আগেই জেনেছি শায়খ আবু তাওয়ামা নগর সুরক্ষার্থে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, এমনও হতে পারে, এর ফলেই পরবর্তীতে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দিতে পেরেছিলেন, যদিও নিশ্চিতরূপে এ-দাবি করা যায় না।
ইবনে বতুতার সফরনামা ‘তুহফাতুন নুজ্জার ফি গারায়িবুল আমসার ও আজায়িবুল আসফার’-এর ইংরেজি অনুবাদক স্যার এইচ এ আর গিব লিখেছেন-
‘ইবনে বতুতার সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানী গুণী ও পীর-আউলিয়াদের সাথে সাক্ষাৎ।’
কথিত আছে
ইবনে বতুতা শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠে আসেন, এবং এখান থেকে সুমাত্রার উদ্দেশে রওয়ানা হন। এইচ এ আর গিবের ইংরেজি অনুবাদে যদিও এই তথ্য পাওয়া যায় না, হতে পারে মূল আরবি কোনো সংস্করণে আছে এবং ইতিহাসবেত্তা ও মুসলিম দার্শনিক সাইয়িদ আবুল হাসান আলি নদবি সেই তথ্য পান।
ইলমে হাদিসের প্রাণকেন্দ্রের সন্ধান
অতঃপর তিনি ছুটে আসেন বাংলায়,— পূণ্যময় সেই ভূমির সন্ধানে যেখানে সূচিত হয়েছিল উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার উদ্দীপনাময় ইতিহাস। খুঁজে পেলেন সোনারগাঁয়ে ঐতিহাসিক বিদ্যাপীঠটির ভবনের ধ্বংসাবশেষ।
স্থানীয় জনসাধারণ জানান, দালানের অলঙ্কৃত তোরণ, প্রশস্ত কক্ষ এবং দোতলায় ওঠা সিঁড়ি প্রমাণ করে যে, ভবনটি একসময় বিদ্যাপীঠ ছিল। দেয়ালগুলো প্রশস্ত এবং পুরু। ইটগুলো ছোট ছোট পাতলা— জাফরি ইট। চারপাশের দেয়ালে মেঝের তিন ফুট ওপর থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত রয়েছে ইটের গাঁথুনিতে করা বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্রাকার চারকোণা খোপ। ধারণা করা হয়, এসব খোপে কিতাবাদি রাখা হতো, এবং এটিই ছিল তখনকার সময়ে সবচে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি।
দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে ময়লা আবর্জনার স্তূপ ও জানালাবিহীন কক্ষ। ভবনের পূর্ব পাশ দিয়ে একটি অপ্রশস্ত সিঁড়ি ভূগর্ভস্থ কুঠুরিতে নেমে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে দু’জন একসাথে নামার উপায় নেই। আট থেকে দশ সিঁড়ি নামার পর মোড় নিতে হয় হাতের বাঁ দিকে, অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না, গা ছমছম করে। সেখানে দশ বর্গফুটের একটি কক্ষ আছে, উচ্চতা বড়জোর ছয় ফুট, একেই বলা হয় আন্ধার কোঠা।
শায়খ আবু তাওয়ামা এই কুঠুরিতে বসে নির্জনে জিকির ও ধ্যান করতেন। টিকে থাকা এ জীর্ণ ভবনটির লাগোয়া আরও অনেক ভবন ছিল, যা ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে।
আবুল হাসান আলি নদবি শায়খের কবর জিয়ারত শেষ করলেন দীর্ঘ মোনাজাতে। নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না, নিজেদের সোনালি ঐতিহ্যের সঙ্গে এহেন অবিচার এবং একদম অনস্তিত্বের মতো ভুলে যাওয়ার অপরাধ উপলব্ধি করে কেঁদে উঠলেন হজরত নদবি।
তাঁর অবেগ ও অবস্থার গভীরতা থেকে বোধ হয়— তিনি যেন বলে উঠেলেন, শায়খ! আমরা দুঃখিত, আমরা ব্যথিত, আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা না পেরেছি আপনার বিদ্যাপীঠ ধরে রাখতে; না পেরেছি জিইয়ে রাখতে আপনার বহুমুখী শিক্ষাদানের পথ ও পন্থা এবং আপনার আদর্শ। সময়কে আমরা কখনোই বুঝিনি। আমাদের ক্ষমা করবেন।
ইলমচর্চার পাশাপাশি এ দেশের প্রাচীন ও নিবিড় সম্পর্কের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিশেবে শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠের গুরুত্ব অপরিসীম। এর যথাযথ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ আবশ্যকীয়। এমনকি জাতীয়ভাবে পদক্ষেপ নিলে এটি হতে পারে গবেষণার যোগ্য স্থান।
তাই যতদ্রুত সম্ভব, এর সংস্কার জরুরি। এ ব্যাপারে পথমে উদ্যোগ নিতে হবে সরকার ও ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিদের। তাহলে পুণ্যবাণীর গুঞ্জরণে আবারও মুখরিত হয়ে উঠবে চারদিক। জেগে উঠবে সাতশো বছরের ইতিহাস, ইলমি দরসে জেগে উঠবে— ‘সোনারগাঁর মৃত ভুবন’।
তথ্যসূত্র-
১. শতাব্দীর চিঠি/মুসা আল হাফিজ
২. ভারতের সুফী/মোবারক করীম জওহর
৩. তবকাত-ই-নাসিরী/মিনহাজ-ই সিরাজ
৪. বাংলাদেশে হাদিসচর্চা : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ/ ড. আহসান সাইয়েদ
৫. ট্রাভেলস অফ ইবনে বতুতা/ এইচ এ আর গিব
৬. বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ/ আকবর আলি খান
৭. উইকিপিডিয়া
৮. বাংলাপিডিয়া
৯. বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধ
এমএমএস/এমএস