যাদের প্রতিটি দিনই হবে রমজান
মাসজুড়ে সিয়াম-সাধনা ছিল মহান আল্লাহর নির্দেশ। মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি ফরজ ইবাদত। এ ইবাদত করেই মুমিন বান্দা আল্লাহকে ভয় করতে শিখেছে। মুত্তাকি হওয়ার অনন্য গুণে গুণান্বিত হয়েছে। ঠিক যেমনটি বলেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-
'হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের আগের লোকদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা মুত্তাক্বি হতে পার।' (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)
মানুষকে মুত্তাকি ও পরহেজগার হিসেবে গড়ে তুলতে রমজান এসেছে, মুমিন মুসলমান মাসজুড়ে সাধ্যমতো আমল ইবাদতসহ রোজা পালন করেছে। পূর্ণ গণনায় ৩০ দিনে মাস পূরণের মাধ্যমে রমজান আবার বিদায়ও নিয়েছে। আর প্রকৃত রোজাদার ও ঈমানদারগণ অর্জন করেছেন তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয়।
রমজানের শিক্ষা
পাপমুক্ত জীবন গঠনে মনোযোগী রোজাদার বিশেষ ৩টি গুণের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে। কেননা এ মাসটি থেকেই মুমিন বান্দা মহান রবের অনন্য ৩টি গুণে নিজেদের রঙিন করে নেয়। এ তিনটি গুণ অর্জনের মাধ্যমেই সব রোজাদারের জীবনকে আলোকিত করতে সক্ষম হয়। তাহলো-
১. কথা কম বলার অভ্যাস।
২. অল্প ঘুমানোর অভ্যাস। আর
৩. সীমিত খাবার খাওয়ার অভ্যাস।
উল্লেখিত গুণগুলো শুধু পরকালের কল্যাণেই ফলপ্রসূ নয়; বরং পরকালের সফলতা পাওয়ার অন্যতম হাতিয়ার। মানুষ যত কম কথা বলবে, মাত্রাতিরিক্ত ঘুম পরিহার করবে এবং কম কম খাবার খাবে; তখনই মানুষ দুনিয়ার শান্তি ও পরকালের কল্যাণ পেয়ে ধন্য হবে।
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবি-রাসুল পাঠিয়ে তাদেরকে রোজার বিধান দিয়ে দুনিয়া থেকেই তৈরি করে নিয়েছেন। উম্মতে মুসলিমাকে এ নেয়ামত ছাড়াও পবিত্র লাইলাতুল কদর দিয়ে ধন্য করেছেন। যাতে দুনিয়ার সফলতা ও পরকালের চূড়ান্ত কল্যাণ অর্জন করতে পারে।
রোজায় তাকওয়া অর্জন
রোজাদারের তাকওয়ার অন্তর্নিহিত মর্ম চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন আল্লামা আবুল হাসান আলি নদভি রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি বলেন-
'একটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রায় দেখা যায়, কোনো শব্দের ভাষান্তর ঘটলে অনেক ক্ষেত্রে ওই শব্দের আসল অর্থই হারিয়ে যায়। তখন সবাই নিজের সুবিধা মতো সেই শব্দের প্রয়োগ করতে থাকে। বর্তমান সময়ে ‘তাকওয়া ও মুত্তাকি’ শব্দের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।’
তাহলে ‘মুত্তাকি’ বলতে কী বুঝি? বড় ইবাদতকারী, যিনি রাতে কম ঘুমান। আর না ঘুমালে আরও বড় মুত্তাক্বি! তখন আমাদের বিশ্বাস এ পর্যায়ে দাঁড়ায় যে-
‘যিনি সদা ইবাদতে লিপ্ত থাকেন,অধিক পরিমাণে নামাজ পড়েন এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সন্দেহজনক বিষয় থেকে ও নিজেকে বাঁচিয়ে চলেন তিনিই মুত্তাক্বি। অধিকাংশ লোকের ধারণাও এমন।
মনে রাখা জরুরি
‘তাকওয়া’ শব্দটি আরবি। ইবাদত করা কিংবা না ঘুমিয়ে রাত কাটানো তাকওয়ার অর্থ নয়। আবার দিনের বেলা রোজা রেখে রাতের নামাজ-আমলে মশগুল থাকাকেও তাকওয়া বলা যায় না। আবার কুরআন তেলাওয়াত ও তাসবিহ পাঠও তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হলো একটি গুণ বা অভ্যাস।
এটি এমন এক স্বতন্ত্র গুণ বা অভ্যাস। যা চেতনা ও যোগ্যতা বা স্বভাবজাত অভ্যাস, যা আমাদের মাঝে সৃষ্টি হওয়ার জন্যই মহান আল্লাহ তাআলা রমজান মাস দান করেছেন। মানুষকে তাকওয়ার গুণে গুণাম্বিত করে মুত্তাকি বানাতেই রমজান মাসের আগমন। রমজানের এ মিশনের কথাই কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘যাতে তোমরা মুত্তাক্বি হতে পার'।'
এবার আমল বাস্তবায়নের পালা
'তাকওয়া বা মুত্তাকি' শব্দটি ছোট মনে হলেও এর অর্থ ব্যাপক। কুরআনের অন্যান্য ছোট ছোট বাক্য ও অলৌকিক এবং বিস্ময়কর শব্দগুলোর মধ্যেও তাকাওয়া অন্যতম। এ আয়াতই তা বুঝিয়ে দিয়েছে যে-
'তাকওয়া'র গুণ শুধু রমজানেই থাকবে আর রমজান শেষ হলে তাকওয়ার গুণ বিদায় নেবে এমন নয়। এমনটি হলে চলবে না। কারণ তাকওয়া কোনো অনুষ্ঠান নির্ভর ইবাদত নয়। তাকওয়া হলো-
‘হৃদয়ের গভীরে জন্ম নেয়া একটি সহজাত চেতনাবোধ। তাকওয়া মানে লজ্জাশীলতা ও শিষ্টাচার লালন করা।’
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে-
কোনো শিশু যদি ভদ্র ও মার্জিত ও উন্নত পরিবেশ বড় হয় এবং সুশিক্ষা ও উন্নত (চারিত্রিক) দীক্ষা পায় তাহলে তার বেড়ে ওঠা এবং চলাফেরাও মার্জিত হয়। তারা বড়দের সম্মান বজায় রেখে চলে। তাদের থেকে বড়দের অপমান, উপহাস, অবাধ্যতা কল্পনাও করা যায় না। শিষ্টাচার ভদ্রতা তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। আর মানুষ তাকে চরিত্রবান আদর্শ ছেলে হিসেবে স্মরণ করে।
কুরআনুল কারিমে ঘোষিত তাকওয়াও সেই শিষ্টাচার, চেতনাবোধ ও গুণের নাম। তবে এ গুণটি মহান আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত। যারাই তাকওয়ার গুণে নিজেকে রাঙিয়েছে, তার মাঝেই প্রকাশ পেয়েছে তাকওয়া। ওই ব্যক্তিই মহান আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করেছে। আর তারাই যে কোনো ইবাদত-বন্দেগিতে আল্লাহর কাছেই নিজেকে ছুঁড়ে দেয়।
রমজানের তাকওয়া অর্জিত হলে-
রমজানের সিয়াম সাধনায় কোনো মানুষের মাঝে তাকওয়ার গুণ অর্জিত হলে সে যে কোনো কাজ করার আগে তার প্রাপ্তি ও পরিণামের বিষয়টি ভেবে দেখে। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিকে বিবেচনায় রাখে। এক কথায় দ্বীন ও শরিয়ত মোতাবেক জীবন পরিচালনার নামই তাকওয়া। হাদিসে এসেছে-
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাকওয়া কাকে বলে? তিনি বললেন-
হে আমিরুল মুমিনিন! আপনি কখনো এমন সরু রাস্তা দিয়ে চলেছেন, যার দুই পাশ দিয়ে রয়েছে সারিবদ্ধ কাঁটার ঝোপঝাড়? ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন- 'হাঁ'।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আপনি তখন কি করেছিলেন?
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমি তখন জামার আস্তীন গুটিয়ে নিজেকে সযত্নে রক্ষা করে পথ চলেছি, যেন কাঁটা বিধতে না পারে। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এটাই তাক্বওয়া!
সুতরাং যারা রমজান মাস পেল, রমজান মাসে দিনে পানাহার বর্জন করে রোজা রাখল, রাতে তারাবিহ, তাহাজ্জুদ ও ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাল এবং একাধিকবার কুরআন খতম করলো তারা অবশ্যই মুত্তাকি।
তবে রমজান পরবর্তী মানসিকতা যেন এমন না হয়-
রোজা পালন ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বা সফল। রমজানের পর আর কোনো আমল-ইবাদত নেই। সব ইবাদত-বন্দেগি ও আমল থেকে মুক্ত। বরং ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে বাকি ১১টি মাসই মুমিন মুসলমানের জন্য প্রকৃত পরীক্ষা। রমজান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আমলি জীনের পরীক্ষা।
রমজানে যেভাবে সতর্কতার সঙ্গে রোজা রেখেছে; সেভাবে সপ্তাহ ও মাসে রোজা পালন করা। রমজানের ইবাদত-বন্দেগির ন্যয় ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে চলা। আল্লাহর নাফরমানি থেকে মুক্ত থাকা।
রমজানে রোজাদার যখন মিথ্যা পরিহার করেছে, সেখানে রমজানের পরে কীভাবে বাকি ১১ মাস মিথ্যার আশ্র নেবে মুমিন। আত্মসাত ও অপবাদ, চুরি ও দূর্নীতি, খুন ও নিপীড়ন রোজাদারের দ্বারা সম্ভব। এসব চিন্তা চেতনা থেকে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ার নামই হলো তাকওয়া!
তাকওয়া বা মুত্তাকি কোনো ইবাদত নয় বরং এটি হলো ঈমানদারদের একটি অন্যতম গুণ বা স্বভাব। রমজান চলে গেছে কিন্তু রমজানের শিক্ষা তাকওয়া মুমিন মুসলমানের মাঝে রয়ে গেছে। যে স্বভাবের বাস্তবায়ন করবে মুমিন মুসলমান।
রমজানের রেখে যাওয়া পয়গামই হলো তাকওয়া। এ তাকওয়ার মাধ্যমেই মানুষ দুনিয়ার যাবতীয় কাজ সম্পাদন করবে। যাবতীয় অন্যায় থেকে বিরত থাকবে। তাকওয়ার গুণেই ইবাদত-বন্দেগি করবে মুমিন। তবে রমজানের সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য সফল ও স্বার্থক হবে।
কেননা আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের ইবাদতকারী হওয়ার, শোকর আদায়কারী হওয়ার কিংবা অন্য কিছু হওয়ার ঘোষণা দেননি বরং তিনি মুত্তাকি বা তাকওয়াবান হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের আগের লোকদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা মুত্তাকি বা তাকওয়া অর্জন করতে হতে পার।' (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)
পরিশেষে…
রোজা পালনে তাকওয়ার অনন্য গুণ অর্জনকারীরা বছরের বাকি ১১ মাস নিয়ম করে রাখবে রোজা। সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আদায় করবে নামাজ। অসহায়-গরিব দুঃখীর মাঝে বিলিয়ে দেবে অর্থ। ভালো কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে। অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকবে। আর এসবই হচ্ছে তাকওয়ার গুণ। যে গুণের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে গেল রমজান।
আল্লাহ তাআলা মুমিন মুসলমানকে বছরের বাকি মাসগুলোতে তাকওয়ার গুণে সব কাজ সম্পাদন করার তাওফিক দান করুন। তাকওয়ার পয়গাম বা সুসংবাদ জীবনের প্রতিটি কাজে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম