অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ার কুরআনি আমল ও দোয়া

ধর্ম ডেস্ক
ধর্ম ডেস্ক ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৪৩ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০২০

যে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব বা সদ্ভাব বজায় রাখার আমল শেখায় কুরআন। কুরআনের উপদেশ ও নীতিবাক্য মানুষের জন্য অমূল্য আমল। এ আমলে যে কোনো লিঙ্গ, বর্ণ, গোত্র ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষকে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে পরিণত করে দেয়; তা এক আরব সাহিত্যিকের নিজের বাস্তব জীবনের ঘটনা ও আমলে ফুটে উঠেছে। 

অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, সুসম্পর্ক ও সুন্দর জীবন লাভে কুরআনের ছোট্ট একটি উপদেশই মানুষের সব শত্রুতা ও মনের অমিল পাল্টে দিতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক নজির রয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানদের জীবনে যুগে যুগে এ নজির চলমান।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে-

এ আমল করতেন স্বয়ং বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এ আমল ছিল সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন ও আউলিয়ায়ে কেরামের জীবনেও রয়েছে হাজারো প্রমাণ। আরব সাহিত্যিক শায়খ সুলাইমান জিলানির একটি ঘটনাও তার নজিরবিহীন প্রমাণ।

কুরআনুল কারিমের একাধিক আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা অন্তরঙ্গ ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার সে উপদেশ তুলে ধরেছেন। যে উপদেশ মেনে চলায় বা আমল করায় শত্রুও বন্ধুতে পরিণত হয়। থাকে মনের কোনো অমিল। আল্লাহ তাআলা বলেন-

- ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُونَ

মন্দ কথার প্রতি উত্তরে তাই বলুন; যা উত্তম। আমি সেই বিষয়েও সবিশেষ অবগত; তারা যা বলে।’ (সুরা মুমিনুন : আয়াত ৯৬)

- وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ

‘সব ভালো ও মন্দ পরস্পর সমান নয়। আপনি মন্দের জবাবে ওই কথা বলুন; যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সঙ্গে যে ব্যক্তির শুত্রুতা রয়েছে, সেও যেন আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হামিম : আয়াত ৩৪)

সুসম্পর্ক গঠনে প্ররোচনামুক্ত থাকার দোয়া

মানুষ যত মন্দ কথা বলে; এর উদ্ভাবক হচ্ছে বিতাড়িত শয়তান। এ কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে মানুষের মন্দ কথা জবাবে উত্তম কথা বলার নসিহত পেশ করেছেন। আর আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তানের প্ররোচনায় মন্দ কথা, কাজ ও আচরণ থেকে বিরত থাকতে তিনি বিশ্বনবিকে এ মর্মে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা দোয়া শিখিয়েছেন-

رَّبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ

উচ্চারণ : ‘রাব্বি আউজুবিকা মিন হামাযাতিশ শায়াত্বিন।’

অর্থ : ‘হে আমার প্রভু! আমি শয়তানের প্ররোচনা (মন্দ কথা) থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (সুরা মুমিনুন : আয়াত ৯৭)

মন্দের জবাবে ভালো আচরণ

মন্দ কথা, কাজ ও আচরণের জবাবে ভালো কথা, কাজ ও আচরণ দেখানো নিঃসন্দেহে পরস্পর অন্তরঙ্গ সুসম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম উপায়। ফলে কারও মাঝে শত্রুতা, ভুল বোঝাবুঝি থাকে না। যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গেই গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক অন্তরের মিল।

ভারতের একটি ইসলামিক ম্যাগাজিন 'মাসিক আরমোগান' এ ম্যাগাজিনে ইসলামিক স্কলার ও দাঈ মাওলানা মুহাম্মাদ কালিম সিদ্দিকী বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিক শায়খ সুলাইমান আল-জিলানির এমনই একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন-

একবার বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিক শায়খ সুলাইমান আল জিলানি তার নিজের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি একবার তার দুই সঙ্গীসহ নিজ গাড়িতে চড়ে এক সফরে বের হন। সফরের রাস্তার ওপর কতগুলো উট পথ বন্ধ করে রাখে। তিনি দেখলেন, দলবদ্ধ উটের সঙ্গে রাস্তার অপর পাশে একটি গাড়িতে বৃদ্ধ একজন লোক বসে আছে।

শায়খ জিলানি বলেন, আমি গাড়ি সামনে নিতে পারছিলাম না উটগুলোর কারণে। উটের রাখালরা উটগুলোকে হাঁকাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো রাস্তা থেকে সরছে না।

আমি ভাবলাম- হর্ন বাজালে হয়তো উটগুলো রাস্তা ছেড়ে দেবে। তাই আমি আমার গাড়ির হর্ন বাজালাম।

হর্ন বাজানোর কারণে রাস্তার অপর পাশে গাড়িতে বসা বৃদ্ধ (উটের মালিক) আমাকে গালাগাল শুরু করে। আমার বাবাকেও অভিশাপ দিতে থাকে। সে বলছে-

অভিশাপ পড়ুক এমন বাবার উপর, যে তোমার মতো ছেলেকে জন্ম দিয়েছে। আমার উট সরাতে হর্ন বাজানোর তুই কে! তোকে যে জন্ম দিয়েছে তার উপরও অভিশাপ, যা তা বলে ওই বৃদ্ধ আমাকে গালি দিতে থাকে। ফলে বৃদ্ধের উপর আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো।

সাধারণ একটি হর্নের জন্য আমাকে এভাবে গালাগালের বিষয়টি আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আর আমি তো ভালোর জন্যই হর্ন বাজিয়েছিলাম; হয়ত আমার হর্ন শুনে উট চলতে শুরু করবে। অথচ হর্নের বদলায় এমন গালি শুনতে হলো?

শায়খ আল-জিলানি বলেন, আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে সজোরে গাড়ি দরজা বন্ধ করে জামার হাতা গুটাতে গুটাতে উটের মালিকের গাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।

গাড়িতে থাকা আমার দুই সঙ্গীর একজন বলছিল- আপনি কী করতে (ঘটনা ঘটাতে) যাচ্ছেন! আর গাড়ির বৃদ্ধ লোকটি আমরা অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলে।

আমি আমার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললাম, আজ নতুন কিছু দেখবেন বলে আমি বৃদ্ধের গাড়ির কাছে গিয়ে উচ্চ শব্দে তার গাড়ির দরজা খুলেই তার কপালে চুম্বন করলাম। আর বললাম-

‘আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমি আপনার উটকে হরণ দিয়ে ভুল করে ফেলেছি। উটকে কষ্ট দিয়েছি। আপনার উটকে কষ্ট দেয়া মানে আপনাকে কষ্ট দেয়ার শামিল। আসলেই আপনার প্রতি বড় অন্যায় করে ফেলেছি। সতুরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।

বৃদ্ধ আশ্চর্য হয়ে আমাকে বলল-

বেটা! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি তো অন্যায় করনি; বরং আমি তোমার বাবা-মাকে গালি দিয়েছি, অভিশাপ দিয়েছি। অথচ তুমি আমার কপালে চুমু খেয়েছ। বরং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।

তখন আমি বললাম-

যেহেতু আপনি আমার বাবা-মা এমনকি আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন, গালাগাল করেছন। আল্লাহর কসম! আমি কেয়ামত পর্যন্ত আপনাকে ক্ষমা করব না। তবে একটি শর্তে আপনাকে ক্ষমা করতে পারি। যদি আপনি তা মানতে রাজি হন।

বৃদ্ধ লোকটি শর্ত  মানতে রাজি হলেন এবং শর্ত জানতে চাইলেন।

আমি বললাম, আমাদের উটেরদুধ পান করাতে হবে। এ কথা শুনে বৃদ্ধ মালিক খুশি হলো এবং রাখালদের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলো। মেহমানদারির আদেশ দিলো। অতপর আমরা পেটভরে উটের দুধ পান করি।

শায়খ আল-জিলানি বলেন, আমি বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম- আপনি শের পারেন? তিনি আমাদের শের শুনাতে শুরু করে। অনেক কবিতা শুনায় আমাদের। এভাবে আধাঘণ্টা অতিবাহিত হলো। অতপর আমরা ওঠার অনুমতি চাইলাম। বৃদ্ধ আমাদের ছাড়বে না বলে জড়িয়ে ধরলেন।

বৃদ্ধ বললেন, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাদের এভাবে যেতে দেবো না।

আমি বৃদ্ধকে বললাম, এমনিতেই আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আল্লাহর ইচ্ছায় পরে এক সময় আপনার মেহমান হবো। এখন যাওয়ার অনুমতি দিন

বৃদ্ধ আবদার জানালেন- হে তিন যুবক! উটের পেছনে পর্দার ভেতরে আমার তিন কন্যা রয়েছে; আর তোমরা তিন জনও আলেম এবং বুদ্ধিমান। তোমরা তাদের বিয়ে করে আমাকে সম্মানিত কর।

কুরআনি নসিহতের উপহার

এ ছিল কুরআনের ছোট্ট নসিহতের উপর আমল করার উপহার। মন্দ কথা ও আচরণের জবাবে শায়খ জিলানির উত্তম আচরণ এ বৃদ্ধকে একান্ত আপন ও অন্তরঙ্গ করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। এ কথাই এসেছে কুরআনে-

সব ভাল ও মন্দ পরস্পর সমান নয়। তাই আপনি মন্দের জবাবে ওই কথা বলুন; যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সঙ্গে যে ব্যক্তির শুত্রুতা রয়েছে, সেও যেন আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হামিম : আয়াত ৩৪)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, যে কারও কটু কথা, খারাপ আচরণ ও গালাগাল শুনে ক্ষেপে না যাওয়া। বরং সুন্দর ও উত্তম ভাষায় মন্দ কথার জবাব দেয়ার মাধ্যমে শত্রু কিংবা মনের অমিল ব্যক্তিকেও আপন করে নেয়া। শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকতে কুরআনে শেখানো ভাষায় আল্লাহর সাহায্য চাওয়াও জরুরি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে শত্রু কিংবা মিত্রদের মন্দ কথা ও আচরণের জবাবে উত্তম ভাষায় কথা বলার তাওফিক দান করুন। কুরআনের উত্তম নসিহতের আমলে শত্রুকে আন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।