মেহমানকে সম্মান ও আপ্যায়ন করার ফজিলত ও মর্যাদা
ইসলামের এ মেহমানদারির মর্যাদা অনেক বেশি। কিন্তু মেহমানদারির ফজিলত ও মর্যাদা অনেকেরেই জানা নেই। আবার কয় দিন, কোন কোন ক্ষেত্রে মেহমানদারি করা আবশ্যক, তাও অনেকে জানে না। এ সম্পর্কে ইসলামে রয়েছে বিস্তারিত দিক নির্দেশনা।
মেহমানদারি সমাজের একটি ব্যপক প্রচলিত নিয়ম। এটাকে অনেকে সমাজ রক্ষার বিষয় হিসেবে জানে। অথচ মেহমানকে সম্মান দেয়া, কদর করা, আপ্যায়ন করা, কুশলাদি বিনিময় করা বিশ্বনবির অন্যতম সুন্নাত।
হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতে, মেহমানদের ভালো খাবার দেয়া একজন গোলাম মুক্ত করে দেয়ার চেয়ে বেশি পছন্দনীয়। আবার কাউকে খাবারের মেহমানদারি করা উত্তম চরিত্রের অংশ বলে মনে করতেন সাহাবায়ে কেরাম।
>> মেহমানদারি নির্দেশনা
ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্যগুলোর মধ্যে মেহমানদারি অন্যতম। মেহমানদারির কারণে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সময়েও বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবিশ্বাসীদের কাছে প্রশংসিত ছিলেন। এ কারণে মেহমানকে সম্মান করা একজন মুসলমানের জন্য ঈমানি দায়িত্ব। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক হাদিসে তা প্রমাণিত-
- নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উদ্দেশ্য করে বলেনম ‘নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার মেহমানের হক রয়েছে।’ (বুখারি)
- অন্য বর্ণনায় বিশ্বনবি বলেছেন, ‘যে মেহমানদারি করে না তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ)
- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যে ঈমান রাখে সে যেন মেহমানের সমাদর করে।’ (বুখারি)
মেহমানদারির অন্যতম প্রতিফল হলো- সহজেই মহান আল্লাহর বন্ধু হওয়া যায়। যেভাবে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। হাদিসে এসেছে-
হজরত আতিয়্যা আওফি রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে যে কারণে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন; তাহলো-
- তিনি মানুষকে (মেহমানদারি) খানা খাওয়াতেন;
- বেশি বেশি সালাম দিতেন; আর
- মানুষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লে তিনি নামাজ আদায় করতেন।’
>> মেহমানের আপ্যায়ন
মেহমানকে আদর সমাদরের সঙ্গে আপ্যায়ন করা বিশ্বনবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অতিথিপরায়ন হিসেবে আরবদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার উর্ধ্বে। তাঁর দরবারে কোনো মেহমান আসলে তিনি সমাদর ও মর্যাদারদ সঙ্গে আপ্যায়ন করতেন, খাবার খাওয়াতেন। খাবার খাওয়ার সময় তিনি বার বার বলতেন, আরও খাবার গ্রহণ করুন। মেহমান খাবার খেয়ে তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি মেহমানকে খাবার খেতে বলতেন।
একবার বনু গিফার গোত্রের এক লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলে তিনি তাঁর মেহমানদারি করেন। অথচ তিনি আগের দিন অভুক্ত ছিলেন। ঘরে ছাগলের দুধ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বিশ্বনবি নিজে অভুক্ত থেকে ঘরে থাকা ছাগলের দুধ দিয়ে মেহমানকে আপ্যায়ন করলেন। তিনি নিজে ক্ষুধার্ত; তা তিনি মেহমানকে বুঝতে দেননি। অনেক সময় মেহমানদারির মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে বিশ্বনবির পুরো পরিবারকে অভুক্ত থাকতে হতো।
>> কেমন মেহমানদারি করা জরুরি
মেহমান আল্লাহর রহমত। পরিবারে মেহমান আসলে, আল্লাহ তাআলা রহমত ও বরকত নাজিল করেন। সে কারণে মেহমান আসলে খুশি হওয়া উচিত। অথচ অনেকেই মেহমান আসলে বিরক্ত মনে করেন। এ ক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখা জরুরি যে, মেহমানে এসে যে খাবার গ্রহণ করে; তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃত নির্ধারিত রিজিক। হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যে ঘরে মেহমানের আসে না; সে ঘরে ফেরেশতা আসে না।’
>> মেহমানদারির উপকারিতা
মেহমানদারি মানুষের দোষ-ত্রুটিকে ঘুচিয়ে দেয়। মেহমানদারি ও উত্তম আপ্যায়ন মানুষের দোষগুলোকে মুছে দেয়। মেহমানের হৃদয়ে আপ্যায়নকারী ব্যক্তির ভালোবাসার জায়গা করে নেয়। এ মেহমান সব সময় আপ্যায়নকারী প্রশংসা করে। এ প্রশংসাই মানুষের দোষত্রুটি মুছে দিতে সাহায্য করে।
>> মেহমানদারির ফজিলত
উত্তম মেহমানদারি ও আপ্যায়ন প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ এভাবে ঘোষণা দেন যে, ‘তারা নিজের ওপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যদিও নিজেরা ক্ষুধার্ত থাকে। আর যারা স্বভাবজাত লোভ-লালসা এবং কামনা থেকে মুক্তি লাভ করে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর : আয়াত ৯)
মেহমানদারির ফজিলত বর্ণনা করে রাসুলে আরাবি ঘোষণা দেন যে, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত মেহমানের সামনে দস্তরখানে খাবার পরিবেশন করা থাকে; ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরেশতারা মেজবানের জন্য আল্লাহর রহমতের দোয়া করতে থাকেন।’
>> মেহমানদারির সময়কাল
মেহমানদারি করা উত্তম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ মেহমানদারি এক নাগাড়ে কতদিন চলবে, সে সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিসে এসেছে-
- নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন মেহমানের সমাদর করে এবং তার হক আদায় করে। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো- মেহমানের হক কী?
তিনি বললেন, এক দিন এক রাত; সর্বোচ্চ মেহমানদারি তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত। এর অতিরিক্ত হলে তা হবে সদকা।’ (বুখারি)
- অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘কোনো মুসলমানের জন্য বৈধ হবে না যে, সে তার ভাইয়ের কাছে এত বেশি অবস্থান করা যে, তাকে গোনাহগার বানিয়ে ফেলে। সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তাকে গোনাহগার কিভাবে বানিয়ে ফেলে?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তার কাছে অবস্থান করতে থাকল আর তার কাছে (আপ্যায়নের জন্য) কিছুই থাকল না যা দ্বারা তাদের মেহমানদারি করবে।’
>> মেহমানের হক
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, মেহমানের হক বা অধিকার হলো ৩টি। তাহলো-
- এক দিন এক রাত মেহমানদারি করা ওয়াজিব।
- দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন মেহমানদারি করা মুস্তাহাব।
- তৃতীয় দিনের পর মেহমানদারি করা সদকা বা অনুগ্রহ।
মুসাফির এবং দূর-দূরান্ত থেকে আগত মেহমানের জন্য এ হকগুলো প্রযোজ্য। আর নিজের এলাকার মেহমানের মেহমানদারি করা মেজবানের ইচ্ছাধীন। চাইলে তার জন্য মেহমানদারির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, আবার চাইলে মেহমানদারি না করারও সুযোগ আছে। তবে মেহমানদারি করাই উত্তম ও কল্যাণের।
মনে রাখা জরুরি
সাধারণত খাবার গ্রহণ করার সময়গুলো নির্ধারণ করে পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনো বন্ধু, আত্মীয় বা প্রতিবেশির বাড়িতে না যাওয়াই উত্তম। ইচ্ছাকৃতভাবে খাবারের সময় তা করা অভদ্রতার শামিল। এমনও হতে পারে যে, সে সময় উপযুক্ত, মান-সম্মত ও পর্যাপ্ত খাবার নাও থাকতে পারে। যার ফলে বন্ধু, প্রতিবেশি কিংবা আত্মীয় অসম্মানবোধ করতে পারেন। কিংবা অসুবিধায় পড়তে পারেন। আল্লাহ তাআলা এ অধরণের অনর্থক অভ্যাস পরিহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়টি লক্ষ্য রেখেই দাওয়াত ছাড়া মেহমান হওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা রয়েছে। কেননা দাওয়াতবিহীন কারো বাড়ি গিয়ে ওঠে পড়া ঠিক নয়। তবে মুসাফির ও দূর-দূরান্তের পথের যাত্রীর কথা ভিন্ন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু মাসউদ বাদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খাবারের দাওয়াত দিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ সেখানে পাঁচজন লোক উপস্থিত ছিল। যখন তারা রওয়ানা হলেন তখন আরও একজন লোক তাদের পিছু নেয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেজবানের দরজায় গিয়েই তাকে বললেন, এই ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে চলে এসেছে। তুমি চাইলে তাকে অনুমতি দিতে পার, চাইলে সে চলে যেতে পারে। তখন মেজবান বলল, হে আল্লাহর রাসুল! ‘না’, আমি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারি না বরং আমি তাকে অনুমতি দিচ্ছি।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের প্রত্যেকেরই উচিত, মেহমানদারির হক ও নিয়মগুলো মেনে চলা। কুরআন-সুন্নায় ঘোষিত ফজিলত ও মর্যাদাগুলো অর্জন। আবার অযথা কাউকে কষ্ট না দেয়া থেকেও বিরত থাকা জরুরি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মেহমানদারির হকগুলো যথাযথ আদায় করার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনাগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস