পবিত্রতা রক্ষায় বিয়ের গুরুত্ব
এ কথা কারও অজানা নয় যে, বিয়ে পারিবারিক জীবনের প্রথম শর্ত। একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মধ্যে সহজীবন-যাপনের শরিয়ত মোতাবেক যে বন্ধন স্থাপিত হয় তারই নাম বিবাহ। বিয়ের বন্ধন কেবলমাত্র গতানুগতিক বা কোনো সামাজিক প্রথা নয়, এটা মানব জীবনের ইহকাল ও পরকালের মানবীয় পবিত্রতা রক্ষার জন্য আল্লাহ পাকের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত। সুতরাং এটা যে কেবল দুনিয়ার জীবনের গুরুত্বই বহন করে এমন নয় বরং পরকালীন জীবনের অধ্যায়েও অনেক গুরুত্ব বহন করে।
সৃষ্টির দিক থেকে পৃথিবীর সবকিছুই মূলতঃ 'নারী-পুরুষ' এ দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত। মানব জীবনের বংশ রক্ষার ধারা বিয়ের বন্ধনে বাঁধা। সৃষ্টির সব প্রাণীর মাঝেই আল্লাহ তাআলা বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা রেখেছেন। কিন্তু মানব জাতির জন্য বংশ রক্ষার প্রক্রিয়া অপরাপর প্রাণীর মত অবাধ নয়। খানিকটা নিয়ন্ত্রণাধীন।
মানুষের জীবন ধারাই ভিন্ন ধরনের, ভিন্ন খাতে প্রবহমান। কারণ এখানে রয়েছে তাদের জাতীয় সভ্যতার প্রশ্ন, ইজ্জত-আবরুর প্রশ্ন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রেম-প্রীতির প্রশ্ন, বংশ মর্যাদার প্রশ্ন, এছাড়াও রয়েছে আধ্যাত্মিকতা লাভের প্রশ্ন, যা সৃষ্টির অন্য কারও মধ্যেই নেই। একমাত্র বৈবাহিক সূত্রে স্থাপিত পবিত্র পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাই এ জাতীয় যাবতীয় প্রশ্নাবলির সঠিক সমাধান দিতে সক্ষম।
সুন্নাত বিয়ে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম সুন্নাত বিয়ে। তিনি বিয়েকে সুন্নাত ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 'বিয়ে আমার সুন্নত। অতএব যে আমার সুন্নত পালন থেকে বিরত থাকবে, সে আমার অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (ইবনে মাজাহ)
বিবাহিত জীবনব্যবস্থা যে শুধু কামনা-বাসনা দমন করে তা নয়, জাতীয় সত্তার পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় গুণাবলিকেও দুর্বার গতিতে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করে তোলে। বৈবাহিক যোগসূত্র ছাড়া নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইসলাম কখনই অনুমতি দেয় না। হাদিসে এসেছে,
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মাঝে যারা বিয়ে করতে সক্ষম তারা যেন বিয়ে করে নেয়। কারণ বিয়ে দৃষ্টি অবনত রাখতে এবং লজ্জাস্থানের পবিত্রতায় অধিক সহায়ক। আর যে বিয়ে করতে সক্ষম নয় সে যেন রোজা রাখে। কেননা রোজা তার যৌনবাসনাকে দমিত করবে।’ (বুখারি)
বিয়ের সক্ষমতা সম্পর্কে ইসলাম
যৌনবাসনা কিংবা বিয়ের সক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়া ইসলামবিরোধী কাজ। হাদিসে এসেছে-
- একবার কিছু সাহাবি প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের কাছে তাদের যৌনবাসনাকে ধ্বংস করে দিতে অনুমতি চাইলো। তিনি তাদের এটা করতে নিষেধ করে দিলেন এবং বিয়ে না করাকে জীবন থেকে পলায়ন করা হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। এ জন্য ইসলাম জীবন থেকে পলায়ন করাকে অপছন্দ ঘোষণা করেছেন।
- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- মানুষের কী হলো? তারা এমন এমন কথা বলে। কিন্তু আমি নামাজ পড়ি এবং ঘুমাই, নফল রোজা রাখি, আবার কখনও রাখি না। আবার বিয়ে-শাদিও করি। অতএব যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম)
বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে নারীকে করা হয়েছে পুরুষের জীবন সঙ্গিনী ও অর্ধাঙ্গিনী। কারণ পুরুষ নিজ জীবনে আপন ভূবনে স্বয়ং সম্পূর্ণ নয় বলেই একজন জীবনসঙ্গিনীর প্রতি একান্ত মুখাপেক্ষী। নারীর অবর্তমানে পুরুষের হৃদয় শূন্য কোঠা সমতুল্য।
প্রশান্তি লাভের মাধ্যম বিয়ে
বিয়ে নারী-পুরুষের জবীনে প্রশান্তি লাভের অন্যতম মাধ্যম। সে কারণে একজন পুরুষের জন্য সুস্থ-সবল, সতী সাধ্বী ধর্মপরায়ণা নারীকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই কেবল তার এ শূন্য কোঠা পূর্ণ হতে পারে। আবার নারীর জন্যও ঠিক একই চারিত্রিক গুণসম্পন্ন পুরুষ তার হৃদয়ের শূন্যতার পরিপূরক। আর তা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক ও পরিপোষক। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আর তার নিদর্শনাবলির মাঝে এটিও একটি নিদর্শন যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মাঝ থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন যেন তোমরা প্রশান্তি লাভের জন্য তাদের কাছে যাও এবং তিনি তোমাদের মাঝে প্রেম-প্রীতি ও দয়ামায়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে সেইসব লোকের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে, যারা চিন্তা ভাবনা করে।’ (সুরা রুম : আয়াত ২১)
নারী-পুরুষের হৃদয়ে প্রশান্তি লাভের নির্ভরযোগ্য এক আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিয়ের বন্ধন। তাই নারী-পুরুষ কেবল বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেই এ পবিত্রময় আশ্রয়স্থলে প্রবেশ করতে পারে। তাই বিয়েকে বলা হয় শান্তির প্রতীক।
বিয়ের এ অসাধারণ গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য করেই মানব সৃষ্টির শুরুতে বৈবাহিক যোগসূত্রের গোড়াপত্তন করা হয়। কারণ এই দাম্পত্য জীবন-যাপনের পূর্বশর্তই হচ্ছে বিয়ের বন্ধন।
সবদিক বিবেচনা করেই পবিত্র কুরআনে মানব সম্প্রদায়কে বিয়ের বন্ধনে অবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
‘যুগল প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য তুমি বিয়ের চেয়ে উত্তম কিছুই খুঁজে পাবে না।’ (ইবনে মাজাহ)
উত্তম বিয়ে
পুরুষের জন্য যে নারীকে বিয়ে করা উত্তম, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেসব নারীর গুণ বর্ণনা করেছেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘(সাধারণত) নারীদের চারটি গুণ দেখে বিয়ে করা। আর তাহলো-
- ধন-সম্পদ
- বংশমর্যাদা
- সৌন্দর্য
- ধর্মপরায়ণতার জন্য।
তোমরা ধর্মপরায়ণ নারীকে বিবাহ করে ধন্য হও, অন্যথায় তোমাদের উভয় হাত অবশ্যই ধুলায় ধূসরিত হবে।’ (আবু দাউদ)
ধার্মিকতাবিহীন নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য সেই পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের ন্যায় যার বাহিরে চাকচিক্য মানুষকে মুগ্ধ করলেও ভিতরটা অসুন্দর। কেননা ধার্মিকতাই নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য। বাহ্যিক অবস্থা যেমনই হোক না কেন ভিতরে তার মণি-মুক্তা আর হিরা-পান্নায় পরিপূর্ণ, যা মানুষের দুনিয়া ও পরকালকে সুন্দর করে গড়ে তোলে।
আবার শুধু নারীর ধার্মিকতার দ্বারাই দাম্পত্য জীবন সুখী হবে এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। কেননা বিয়ে উত্তর দাম্পত্য জীবনের সর্বাঙ্গীন সাফল্যের জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ভূমিকাই সমান। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা দেখ কোনো ব্যক্তি বিবাহ করেছে, সে ধর্মের অর্ধেক পূর্ণ করেছে, এরপর তারা উভয়ে বাকি অর্ধেকের জন্য আল্লাহকে ভয় করুক।’ (বায়হাকি)
ইসলামে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ছাড়া নারী-পুরুষের যে কোনো ধরনের পারস্পরিক সম্পর্ককেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া এটি মানবস্বভাববিরুদ্ধ কাজ। এতে গোনাহ ছাড়া কোনো পুণ্য নেই।
আমাদের হয়তো জানা নেই যে, বিয়ে মানুষকে এক নতুন শান্তিপূর্ণ জীবন ও সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকে। যে পথ মানুষের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সফলতার আসল চাবি-কাঠি।
তবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে যারা বিয়ে করতে যাচ্ছেন তাদেরকে অবশ্যই সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্য নীতি মেনেই বিয়ে করা জরুরি। কেননা সুস্থ ও নিরাপদ জীবন লাভে স্বাস্থ্য নীতি মেনে চলার বিকল্প নেই।
তাই আসুন, দুনিয়ায় জান্নাতি পরিবেশ ও প্রশান্তিময় জীবন লাভে সুন্নাত পদ্ধতিতে বিয়ের বন্ধন আবদ্ধ হই। যাবতীয় অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে বিরত থাকি।
হে আল্লাহ! মুসলিম উম্মাহকে গোনাহমুক্ত পবিত্র দাম্পত্য জীবন গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস