যে কারণে অনন্য বৈশিষ্ট্যের মাস শাওয়াল
হিজরি সনের দশম মাস শাওয়াল। এটি একদিকে রমজান পরবর্তী ঈদুল ফিতরের মাস আবার হজের কার্যক্রমের তিন মাসের (শাওয়াল-জিলকদ-জিলহজ) প্রথম মাসও এটি। এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে হজের প্রস্তুতির জন্য ওমরার অনুমোদনও বন্ধ করে দেয়া হয়। যদিও এ বছর মহামারি করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে ওমরাহ। হজও প্রায় অনিশ্চিত। তবে বছর জুড়ে রোজার সাওয়াবের পরিপূর্ণতার মাস এটি। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু আইয়ুব আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা রাখলো এবং শাওয়াল মাসে ৬টি রোজা রাখলো, এটি (শাওয়ালের ৬ রোজা) তার জন্য সারা বছর রোজা রাখার সমতুল্য।’ (মুসলিম)
রমজান পরবর্তী এ মাসটি বিভিন্ন দিক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশিষ্ট। ‘আশ শাওয়াল আল মুকাররম’, অর্থাৎ সম্মানিত শাওয়াল মাস। যে ৪ কারণে এ মাসটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার দাবি রাখে, তাহলো-
- ঈদুল ফিতর
মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি হয় এ মাসে। আর সেটি হলো রমজানের সিয়াম সাধনার পর মুমিন মুসলমানের অনন্য উৎসব ঈদুল ফিতর। অনাবিল খুশির বার্তা নিয়ে পশ্চিম আকাশে হেসে ওঠে শাওয়ারের নতুন চাঁদ। সে কারণেই শাওয়ালের প্রথম দিন মুসলিম উম্মাহর ধনী-গরিব নির্বিশেষ একাকার হয়ে ঈদ-আনন্দ উদযাপন করে থাকে। হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি সম্প্রদায়ের আনন্দের দিন রয়েছে, আর এটি (শাওয়ালের প্রথম দিন বা ঈদুল আযহার দিন) আমাদের আনন্দের দিন।' (বুখারি, মুসলিম)
- হজ
হজ সম্পাদনের তিন মাসের প্রথম মাস শাওয়াল। শাওয়াল, জিলক্বদ, জিলহজ- এ তিনটি মাস জুড়ে হজের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, হজ (এর সময়) কয়েকটি মাস নির্ধারিত।' (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৭)
কুরআনের এ আয়াতে ঘোষিত হজের নির্ধারিত মাসসমূহের মধে একটি হলো শাওয়াল। নির্ধারিত কয়েক মাস’এর ব্যাখ্যায় সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ শাওয়াল, জিলক্বদ ও জিলহজের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে, জিলহজ্ব মাস পূর্ণটা নাকি প্রথম দশদিন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। (তাবারি, কুরতুবি)
ইমাম বুখারির বর্ণনায় হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, 'নির্ধারিত কয়েকমাস দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- শাওয়াল, জিলক্বদ ও জিলহজ মাসের প্রথম দশদিন।' ( তাফসিরে ইবনে কাসির)
চাইলে যে কেউ ঈদুল ফিতরের দিন থেকেই পবিত্র হজ পালনের জন্য ইহরাম করতে পারে। আর এ কারণেই শাওয়াল মাস অনন্য মর্যাদার দাবি রাখে।
- ছয় রোজা
পবিত্র শাওয়াল মাসে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ছয়টি নফল রোজা রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এ মাসে ছয়টি নফল রোজা রাখতে উম্মতকে বিশেষ উৎসাহিত করেছেন।হাদিসে এসেছে-
- হজরত আবু আইয়ুব আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজাগুলো রাখলো অতপর শাওয়াল মাসে আরও ছয়টি রোজা রাখলো, সে যেন সারাবছরই রোজা রাখলো।' (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি)
এ হাদিসটি মূলত পবিত্র কুরআনুল কারিমের সুরা আনআমের ১৬০নং আয়াতের সমর্থন বহন করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘যে কেউ কোনো নেক আমল করবে তাকে তার দশ গুণ সওয়াব প্রদান করা হবে।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১৬০)
এ আয়াতের আলোকে রমজান মাসের রোজার ১০ গুণ সাওয়াব দেয়া হলে তা হবে ৩০০ দিন আর শাওয়ালের ৬ রোজার সাওয়াব ১০ গুণ হলে তা হবে ৬০ দিন। মোট ৩৬০ দিনে আরবি বছর পূর্ণ হয়ে যায়। আর সে হিসেবেই সারা বছর সাওয়াব লাভ করে মুমিন। যার পরিপূর্ণতা আসে এ শাওয়াল মাসে।
- বিয়ের জন্য উত্তম মাস
উত্তম দাম্পত্য জীবন গঠন তথা বিবাহ বন্ধনের অনন্য মাসও শাওয়াল। এ মাসের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আম্মাজান হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর আম্মাজান হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাও এ মাসেই স্বামীর ঘরে আগমন করেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশঅ রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে শাওয়াল মাসে বিবাহ করেন, শাওয়াল মাসেই আমার সাথে মিলিত হন। রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন স্ত্রী আমার চেয়ে বেশি সম্ভোগ্য ছিলেন? আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার বংশের মেয়েদের শাওয়াল মাসে বিয়ে দেয়া ও শাওয়াল মাসে বাসর ঘরে পাঠানো কে উত্তম মনে করতেন।' (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ)
তবে প্রাচীন আরবের লোকেরা শাওয়াল মাসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে কুলক্ষণে মনে করতো। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এ হাদিস দ্বারা সে অমূলক ধারণাক খণ্ডন করেছেন। যেন কোনো অঞ্চলের মানুষ এ মাসের বিয়ে-শাদিকে কুলক্ষণে মনে না কর। যা হাদিসের পরিপন্থি ও অমূলক কাজ।
এ হাদিসের উপর ভিত্তি করে বহু ওলামায়ে কেরাম শাওয়াল মাসে বিয়ে ও বাসরকে মুস্তাহাব সাব্যস্ত করেন।
সর্বোপরি রমজানের রোজার মতো শ্রেষ্ঠ একটি ইবাদত পালনেও নানা ধরণের অসঙ্গতি, ভ্রান্তি বা অপূর্ণতা থেকে যেতে পারে। সেই অপূর্ণতা বা ঘাটতির পরিপূরক হিসেবে অফুরন্ত রহমত ও বরকতের ভাণ্ডার নিয়ে হাজির হয় শাওয়ালের ছয় রোজা। যা রমজানের ফরজ রোজার ভুল-ভ্রান্তির ঘাটতিস্বরূপ। যা রোজাদারের নেকের পাল্লা ভারী করে দেয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শাওয়ালের বাকি দিনগুলোতে ফজিলতপূর্ণ এ মাসের অনন্য বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা লাভে রোজা পালন ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম