কুরআন যেভাবে আমরা পেলাম
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। মানুষের জন্য আল্লাহর দেয়া একমাত্র জীবনব্যবস্থা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর পবিত্র হেরা গুহায় নাজিলকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ মুজিজা গ্রন্থ। আল্লাহ তাআলা এ গ্রন্থ মানুষের বুকে ধারণ করিয়ে অবিকল সংরক্ষণ করেছেন। পৃথিবীতে যার নমুনা দ্বিতীয়টি আর নেই।
কুরআনুল কারিমের ভাব-ভাষা-বর্ণ সবই আল্লাহ তাআলা নাজিল করেছেন। এর প্রবক্তা স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। এটি দীর্ঘ ২৩ বছরে সাইয়্যেদুল মুরসালিন, খাতামুন্নাবিয়্যিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাজিল হয়েছিল। যাতে মানুষ কুরআনের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারে।
সে কারণেই আল-কুরআনের আলোচ্য বিষয়ই হলো মানুষ। কুরআনে যত ভাব, ভাষা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, আদেশ নিষেধ তথা সব বিধি-বিধানই মানুষের জন্য। যখন এই কুরআন বাণী আসা শুরু হয় তখন থেকেই সাহাবায়ে কেরাম তা ক্বলবে ধারণ তথা মুখস্ত করতেন আবার তা লিখেও রাখতেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের আয়াতগুলো লিখে সংরক্ষণের জন্য হজরত যায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি কাতেবে ওহি হিসেবে পরিচিত।
এ ছাড়া খোলাফায়ে রাশেদার চার খলিফাসহ আরও অনেক সাহাবি ওহি লিখে রাখার দায়িত্ব পালন করেছেন। কুরআনের আয়াতগুলো প্রথমত সাহাবায়ে কেরাম ক্বলবে ধারণ করতেন। কুরআনের কোনো আয়াতের ব্যাপারে একাধিক কোনো বর্ণনা বা মতপার্থক্যের তথ্য নেই। যারা কুরআন মুখস্ত করেছেন। তাদের সবার মুখস্ত ছিল হুবহু এক রকম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে রকম বলেছেন।
তারপরও অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য নিযুক্ত কাতেবে ওহি বা ওহির লেখকগণ ইসলামের প্রাথমিক যুগে কুরআনুল কারিমের আয়াতসমূহকে খেজুরের ডাল, গাছের পাতা, পাথর, চামড়াসহ ইত্যাদি উপকরণের উপর লিখেই সংরক্ষণ করা হত। তবে লিখিত অংশগুলো বিভিন্ন জনের কাছে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল।
কুরআন একত্রিত করার উদ্যোগ
ইসলামের শুরুর দিকে ইসলাম চরম বাধার মোকাবেলা অবতীর্ণ হয়। ইসলামের শত্রুতরা ইসলাম ও মুসলমানকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার মানসে সারা দুনিয়ার অমুসলিমদের সঙ্গে একত্রিত হয়। বিভিন্ন সময় প্রবল শক্তি নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তাদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ খোলাফায়ে রাশেদার আমিরুল মুমিনিনগণ সেসব যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হয়েছে। আর সেসব যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন। অনেক হাফেজে কুরআন।
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহ সময়ে ইয়ামামার যুদ্ধে সর্বোচ্চ সংখ্যক হাফেজে করআন শাহাদাত বরণ করলে সর্ব প্রথম হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কুরআনুল কারিম লিখিতভাবে একত্রিত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। যা হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমলে গিয়ে শেষ হয়।
অবশেষে কুরআন একত্রিত করার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে এসে পৌছে। হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ৪ সদস্য বিশিষ্ট প্রসিদ্ধ সাহাবাদের সম্বন্বয়ে গঠিত কমিটি পবিত্র কুরআনকে একত্রিত করেন। যা বর্তমান সময়ে মুসলিম উম্মাহর কাছে থাকা আজকের কুরআন।
হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু কুরআন একত্রিত করে তা সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেন। আর এভাবেই আজ পর্যন্ত অবিকল কুরআন এখনও আমাদের মাঝে বিরাজমান।
তবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় যারা ওহি লিখে রাখতেন তাদের মধ্যে অন্যতম যারা ছিলেন। তারা হলেন-
- হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু।
- হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু।
- হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু।
- হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রাদিয়াল্লাহু আনহু।
- হজরত সালেম মাওলা হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু।
- হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু।
- হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু।
- হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু।
- হজরত আবু জায়েদ কায়েস ইবনিস সাকান রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ।
কুরআন বিন্যস্তকরণ পদ্ধতি
কুরআনুল কারিমের লিখিত কপি করতে গিয়ে ৪ সদস্য কমিটির প্রসিদ্ধ সাহাবাগণ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে সুবিন্যস্ত করেছেন। আর তাহলো-
- সুরা : ১১৪।
- মনজিল : ৭।
- পারা : ৩০।
- রুকু : বড় সুরায় একাধিক রুকু।
- আয়াত : প্রতিটি সুরায় সর্বনিম্ন ৩ আয়াত। আর সর্বোচ্চ রয়েছে ২৮৬ আয়াত।
- ওয়াক্ফ : প্রতিটি সুরায় রয়েছে অনেক ওয়াক্ফ। যার কিছু পালন করা ওয়াজিব, কিছু স্থানে থামা উত্তম। কিছু স্থানে থামা নিষেধ আবার কিছু স্থানে থামা জায়েজ।
তাইতো সারা পৃথিবী জুড়ে কুরআন কারিমের সূরা, মনজিল, পারা, রুকু, ওয়াক্ব ফইত্যাদি থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ধাপে ধাপে কোথাও কোনো অমিল বা মত পার্থক্য আজও পর্যন্ত দেখা দেয়নি। যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠ মু`জেজা হওয়ার একমাত্র কারণ। যা আরবি ভাষায় রচিত।
তৎকালীন আরবের সবচেয়ে বড় বড় পণ্ডিত আরবি সাহিত্যিকগণ বহু চেষ্টা করেছেন কুরআনকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বানানো কথা বা ভাষা প্রমাণের চেষ্টা করার জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তামাম পৃথিবীর সব নাস্তিক, মুশরিকদের প্রতি। আল্লাহ বলেন- ‘এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো। তোমাদের সে সব সাহায্যকারীদেরকে সঙ্গে নাও, এক আল্লাহকে ছাড়া; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সূরা বাক্বারা : আয়াত ২৩)
এরপর নাস্তিক, মুশরিকরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বহু চেষ্টা করেছেন। তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে; একটি আয়াতও তারা তৈরি করতে পারেনি। পরবর্তীতে ব্যর্থ হয়ে তারা সূরা কাওছারের একটি আয়াতের ছন্দের সাথে মিলিয়ে কুরআন কারিমের সত্যতা ঘোষণায় এক লাইন রচনা করেছিল।
আর তা ছিল এই-
ইন্না- আ`ত্বাইনা- কাল কাওছার।
‘লাইসা হাজা কালামুল বাশার’ ইহা মানুষের রচিত কোনো ভাষা নয়। অর্থাৎ নি:সন্দেহে ইহা আল্লাহ পাকের কালাম।
হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু`র সময় কুরআনের যে লিখিতরূপ তৈরি করা হয়েছিল তা ছিল হরকতবিহীন। পরবর্তীতে পড়ার সুবিধার্থে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ কুরআনুল কারিমের হরকত সংযোজন করেন। যা অনারবী (আরবি ভাষাভাষি নয়) তথা মুসলিম বিশ্বের সব মুসলমানের তিলাওয়াত উপযোগী হয়েছে। এবং সব মুসলমান দেখে দেখে সুন্দর করে তিলাওয়াত করতে পারেন।
সুতরাং কুরআন আল্লাহর কিতাব; যা সংরক্ষণ আমাদের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য। মানব জীবনের এর বাস্তব প্রতিফলনও ঈমানের অনিবার্য দাবি। তাই কুরআনকে সংরক্ষণ ও মানব জীবনে বাস্তবায়ন করারই তাওফিক চাই, সেই মহান মনিবের দরবারে-
যিনি এই কুরআনের সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। আল্লাহ নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয় আমি এই কুরাআন (মানুষের জীবন পরিচালনার গাইডস্বরূপ) নাযিল করেছি। আমি নিজেই তা হেফাজত বা সংরক্ষণ করব।`
আল্লাহ সব মুসলিমকে কুরআনের সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নে সফল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস