সন্তানকে চরিত্রবান করে গড়ে তোলা বাবার দায়িত্ব

ধর্ম ডেস্ক
ধর্ম ডেস্ক ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৫১ পিএম, ২৬ জানুয়ারি ২০২০

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে জুমআর খুতবা নির্ধারণ করা হয়। ইউরোপের দেশ হলেও তুরস্কে রয়েছে এ নিয়ম। দেশটির অধিকাংশ মসজিদে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়ের ওপর হয় জুমআর বয়ান। গত ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার জুমআর জন্য নির্ধারিত বিষয় ছিল- ‘সন্তানকে চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলাই বাবার প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য’।

তুরস্কের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত খুতবায় সন্তানের প্রতি বাবার দায়িত্ব পালনের বিষয়গুলো কুরআন হাদিসের আলোকে এভাবে উঠে এসেছে। খুতবায় বলা হয়েছে-

পারিবারিক জীবনে আল্লাহ তাআলার দেয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হলো সন্তান। শান্তি, নিরাপত্তা, আশ্রয়, সমস্যার সমাধান সবই পরিবার থেকে শিশু সন্তান। সন্তানকে ভালো কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করা, অন্যায়ের মোকাবেলা সর্বোপরি প্রতিবাদের পদ্ধতি শেখার অনত্যম প্রতিষ্ঠানও হলো পরিবার।

যোগ্য উত্তরসূরী গঠনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিবার। বেশিরভাগ সময় পরিবারের সার্বিক পরিচালনা করেন সন্তানের বাবা। বাবাকে সহযোগিতা করেন সন্তানের মা। যার অবদান কোনো অংশেই কম নয়। এ পরিবার থেকেই সন্তান শিখতে শুরু করে। তার চরিত্র পরিবারের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে। কাউকে সম্মান করা, সততা অবলম্বন ও ভালোবাসা সবকিছুই পরিবারের বাবা-মা থেকে শেখে।

সন্তানকে আদর্শ চরিত্রবান সুনাগরিকে হিসেবে তৈরি করতে বাবার ভূমিকা অনেক বেশি। পরিবারের অর্থিক প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যমেই একজন বাবার দ্বায়িত্ব পালন শেষ হয়ে যায় না। বরং সুহৃদ, চরিত্রবান, আত্মমর্যাদার অধিকারী হিসেবে সন্তানদের গড়ে তোলাই বাবার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সন্তানের জন্য পিতার রেখে যাওয়া উত্তম চরিত্র থেকে শ্রেষ্ঠ কোনো মিরাসী (উত্তরাধিকার) সম্পত্তি হতে পারে না।’ (তিরমিজি)

দুনিয়া ও আখেরাতে সন্তানের কল্যাণ কামনায় চিন্তা-মগ্ন থাকা। কোনো ব্যক্তির বাবা হওয়া মানে সে ব্যক্তির উচিত তার সন্তানকে হজরত নূহ আলাইহিস সালামের মতো সন্তানকে ঈমানের ছায়াতলে আশ্রয় করে দেয়ার প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

পয়গম্বর নূহ আলাইহিস সালামের সন্তান আল্লাহ ও তার বিরোধী ছিল। তিনি সন্তানকে আল্লাহর পথে আসার জন্য অনেক আহ্বান করেছিলেন। এমনকি মহাপ্লাবনের আগেও মুমিনদের সাথে নৌকায় উঠতে অস্বীকারকারী সন্তানকে সম্বোধন করে শেষ বারের মতো বাবাসুলভ আহ্বান করে বলেছিলেন। তাঁর সে আহ্বান কুরআনুল কারিমে এভাবে উঠে এসেছে-
‘আর নৌকাখানি তাদের বহন করে চলল পর্বত প্রমাণ (পানির) তরঙ্গমালার মাঝে, আর নূহ (আলাইহিস সালাম) তাঁর পুত্রকে ডাক দিলেন আর সে সরে রয়েছিল। তিনি বললেন, প্রিয় ছেলে! আমাদের সাথে আরোহন কর এবং কাফেরদের সাথে থেকো না।

সে বলল, আমি অচিরেই কোনো (উঁচু) পাহাড়ে আশ্রয় নেব, যা আমাকে পানি হতে রক্ষা করবে। নূহ (আলাইহিস সালাম) বললেন, আজকের দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কোনো রক্ষাকারী নেই। একমাত্র তিনি যাকে দয়া করবেন। এমন সময় উভয়ের মাঝে (পানির) তরঙ্গ আড়াল হয়ে দাঁড়াল, ফলে সে নিমজ্জিত হল। (সুরা হুদ : আয়াত ৪২-৪৩)

বাবাকে হতে হবে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মতো। যে বাবা সব সময় সন্তানের কল্যাণে দোয়া করবে। যাতে করে সন্তান আল্লাহর অনুগত নেককার বান্দা হতে পারে। প্রত্যেক বাবার উচিত নিজ সন্তানকে সৎ ও যোগ্য উত্তরসূরী হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে শুণ্য হাতে প্রার্থনা করা। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার সন্তানের জন্য সেভাবেই দোয়া করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-

‘হে পরওয়ারদেগার! আমাদের উভয়কে (বাপ-বেটাকে) তোমার অনুগত বান্দাদের অর্ন্তভূক্ত করো। আর আমাদের বংশধর থেকেও তোমার একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর। আমাদের আত্মত্যাগের (ইবাদতের) নিয়ম-নীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। নিশ্চয় তুমি তওবা কবুলকারী, দয়ালু।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৮)

অন্য আয়াতে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সন্তানের জন্য আরও দোয়া করেন-
‘হে আমার পালনকর্তা, আমাকে ও আমার সন্তানদের নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে সাব্যস্ত কর এবং আমাদের দোয়া কবুল কর।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪০)

এমনিভাবে হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের মতো অটল অবিচল হতে হয়। যে কোনো বড় বিপদেও চরম ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে। সন্তানের সামনে সন্তুষ্টি, দয়া, মমতা, অনুগ্রহ, ন্যয় ও ভালোবাসার শিক্ষা তুলে ধরতে হবে। সন্তান কোনো কারণে ভুল করলে তা থেকে সতর্ক করতে হবে। সুরা ইউসুফে আল্লাহ তাআলা সে ঘটনা তুলে ধরেন। হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ধৈর্যের বিষয়টিও এ সুরায় উঠে এসেছে। আল্লাহ তাআলা বরেন-

‘তারা (সন্তানরা) বলল, হে পিতা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম এবং ইউসুফকে আসবাব-পত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। অতপর তাকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী। এবং তারা (সন্তানরা) তার জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে আনল। (বাবা) বললেন, এটা কখনই নয়; বরং তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা কথা সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এখন সবর করাই শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করেছ, সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্য স্থল।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ১৭-১৮)

সুরা লোকমানে উঠে এসেছে, সন্তানের প্রতি বাবার উপদেশগুলো। যেগুলো একজন বাবার জন্য অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।’ সন্তানকে হালাল, হারাম ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছেন বাবা। প্রথমেই তাওহিদের উপদেশ দিয়েছেন। কুরআনের ভাষায়-

‘যখন লোকমান উপদেশ হিসেবে তার সন্তানকে বললঃ হে ছেলে! আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৩)

সন্তানের প্রতি উপদেশ হিসেবে সুরা লোকমান-এর ১৬ থেকে ১৯নং আয়াতে এসেছে-
- ‘হে (প্রিয়) সন্তান! কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।
- ‘হে (প্রিয়) সন্তান! নামাজ কায়েম কর, সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ।
- অহংকার করে তুমি মানুষকে অবহেলা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক- অহংকারীকে পছন্দ করেন না।
- চলাফেরায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর এবং কন্ঠস্বর নীচু রেখো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’

উম্মতে মুসলিমার প্রত্যেক বাবার উচিত, প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত মোতাবেক পরিবার, সন্তান-সন্তুতি পরিচালনা করা। কেননা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আদর্শ পিতা ও পরিবারের প্রধান। তিনি সন্তানদের মধ্যে ছেলে ও মেয়েতে কোনো পার্থক্য করেননি। হাদিসের বর্ণনায় এসেছে-
‘তিনি মেয়ে ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে দেখেও দাঁড়িয়ে যেতেন। তার হাত ধরতেন। তাকে ভালোবাসতেন, চুমু খেতেন এবং নিজের আসনে বসাতেন।’

প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু নিজের শিশুকেই মায়া-মমতা করতেন না, তিনি সব শিশুকেই আদর-সোহাগে ভরিয়ে দিতেন। তার সুমহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
‘আমি দশ বছর তাঁর খেদমত করেছি। আল্লাহর শপথ! দশ বছরে একবারও আমাকে ‘উফ’ শব্দটি পর্যন্ত বলতে হয়নি।’ (মুসলিম)

তাই প্রত্যেক সন্তানই তার বাবা থেকে সর্বোত্তম আচরণ আশা করে। যেখানে সন্তানের জন্য রয়েছে আদর্শ ও চরিত্রবান শিক্ষা। সন্তান পাবে সঠিক পথের দিশা।

বিশ্বব্যাপী মসজিদগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তুলে ধরলে সমাজ থেকে দূর হবে অসামাজিক কার্যকলাপ ও ন্যয়-নীতি বিবর্জিত কুসংস্কার ও অন্যায়। সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবে ইনসাফ।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব বাবা ও পরিবারের প্রধানকে ইসলাম, দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হিসেবে কাজ করার তাওফিক দান করুন। সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা, অনুগ্রহ ও নীতি-নৈতিকতা ও দোয়া শেখানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।