ইজতেমা ময়দানে যে বয়ান দিলেন তাবলিগের শীর্ষ মুরব্বি আহমদ লাট
টঙ্গীর তুরাগ তীরে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দিন ছিল শুক্রবার। এ দিন মাগরিবের নামাজের পর দেশ-বিদেশ থেকে আগত তাবলিগের সাথীদের উদ্দেশ্যে বয়ান পেশ করেন বিশ্ব তাবলিগের অন্যতম শীর্ষ মুরব্বি ভারতের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আহমদ লাট।
তিনি হামদ-ছানা ও দুরূদ পড়ে তাবলিগের মাকসাদের কথা স্মরণ করানোর এক গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেন। তার বয়ানটি তুলে ধরা হলো-
দুনিয়ার একটা নিয়ম হলো, কোনো ব্যক্তি যখন কোনো জিনিস বানান, তখন তিনি সে জিনিসের ব্যবহার পদ্ধতি এবং উদ্দেশ্য জানিয়ে দেন। দুনিয়াতে যত মানুষ রয়েছে সব মানুষকেই আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ কুরআনে মানুষ সৃষ্টির কথা ও তার কাজ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে বলেন-
‘আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি আমার ইবাদতের জন্য৷’ এমনিভাবে কিছু আদেশ নিষেধ দিয়েছেন সেগুলো মেনে চলার জন্য৷
আল্লাহর আনুগত্য করার সবচেয়ে উত্তম নিদর্শন রয়েছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে। রাসুলের মতো করে আল্লাহকে মানলেই তিনি আমাদের উপর খুশি হয়ে যাবেন।
তিনি আরও বলেন, আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করে অনেক অনুগ্রহ করেছেন৷ আমাদের কী নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে সেসব উপয়-পদ্ধতিও বাতলে দিয়েছেন।
এমন নয় যে, তিনি আমাদের সৃষ্টি করে ছেড়ে দিয়েছেন। বরং কীভাবে চলতে হবে সেসব তরিকা তিনি বলে দিয়েছেন। এই তরিকা মেনে চলার নামই দ্বীন।
আল্লাহর পথে চলার সব তরিকা শুধুমাত্র আলেমদের কাছে জানা যাবে। তারাই বলে দেবেন কোন আমল কীভাবে করতে হবে। এই জন্য আমাদের সবসময় আলেমদের শরণাপন্ন হতে হবে।
আলেমরা বলেন, আল্লাহর কাছে যদি দ্বীন ছাড়া অন্য কিছু প্রিয় হতো তাহলে তিনি রাসুলদের সেসব জিনিস দান করতেন। আল্লাহর কাছে দ্বীন ও দ্বীনের মেহনতই বেশি প্রিয়। এই দুই কাজের জন্যই তিনি নবী রাসুলদের পাঠিয়েছেন।
আলেমরা বলেন, ইনসান (মানুষ) ও হায়ওয়ান (পশু)-এর মাঝে বুনিয়াদি পার্থক্য হলো দ্বীন। কারণ মানুষ ছাড়া অন্য কারো জন্য ধরাবাঁধা কোনো দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) বা শরিয়ত (বিধান) নেই।
যেদিন থেকে মানবজাতির জন্ম হবে, সেদিন থেকেই তার কোনো ছাড় নেই। যেমন- কোনো সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর আল্লাহু আকবর বলে (আজানের মাধ্যমে) তাকে প্রথম শিক্ষা দেয়া হয় যে, আল্লাহ সবচেয়ে বড়৷ এটাই জন্মের পর শিশুর কানে শিক্ষা দেয়া হয়। যেন সে, আল্লাহকে মেনে চলে, বড় মনে করে, ভুলে না যায়। অন্তরে আল্লাহকে ধারণ করে, লালন করে৷ হৃদয়ে বসিয়ে নেয়। (আল্লাহ ছাড়া) কোনো কিছুই যেন তার চোখে বড় না আসে। সেই শিক্ষাই জন্মের পর দেয়া হয়।
আল্লাহ সবচেয়ে বড়। তাকে ধারণ করার একমাত্র জায়গা দিল (কল্ব)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
‘প্রত্যেক মানুষের ভেতর একটা টুকরো (মাংশ) থাকে৷ যার নাম দিল (আত্মা)। যখন সেটা সুস্থ থাকে তখন পুরো দেহ সুস্থ থাকে। যার দিল (আত্মা) আল্লাহর ভালোবাসায় পূর্ণ থাকে তার উপর আল্লাহ রাজি হয়ে যান।
এমন নয় যে, মানুষের দিল দুইটা। একটাতে আল্লাহকে রাখবে। অন্যটাতে দুনিয়ার লোভ-লালসা ও মোহ রাখবে। বরং দিল একটাই যেখানে শুধুমাত্র আল্লাহর বড়ত্ব বসাবে৷
দিলের মধ্যে চারটা রাস্তায় কথা প্রবেশ করে-
>> জবান,
>> কান,
>> চোখ ও
>> দেমাগ।
মানুষ যখন রাতে ঘুমায় তখন তার তিনটি রাস্তা (জবান, কান ও চোখ) বন্ধ হয়ে যায়। একটি রাস্তা খোলা থাকে, সেটা হলো দেমাগ।
দেমাগ তখন (ঘুমের মধ্যে) জবান, কান ও চোখের ব্যবহৃত জিনিসগুলোকে চিন্তা করতে বাধ্য হয়ে যায়। সুতরাং আমাদের জীবন শুরু করতে হবে আল্লাহ সবচেয়ে বড় এই ধ্যান-ধারণা নিয়ে৷
নিজেকে বড় করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বরং তুমিও দুনিয়ার সব মূল্যবান ধাতু মাটি থেকে সৃষ্টি।
তাই এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আল্লাহর বড়ত্ব দীলে পোক্তভাবে বসাবে। মানুষকে বড় করে দেখার কোনো অবকাশ নাই।
মানুষকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, আবার সে মাটির সাথেই মিশে যাবে। বরং মানুষ এমন গান্ধা জিনিস দ্বারা সৃষ্টি যা আলোচনা করাও লজ্জাকর৷ তাই নিজের কোন কামাইকে (অর্জন) বড় মনে না করে আল্লাহকে বড় করে দেখবে।
আল্লাহ তাআলার মানুষ সৃষ্টি করার যেমন মাকসাদ (উদ্দেশ্য) রয়েছে, তেমনি মাওলানা ইউসুফ রাহমাতু্লাহি আলাইহি-এরও দাওয়াত তাবিলগের মাকসাদ রয়েছে। তিনি এ মাকসাদ সম্পর্কে ৩ বার কসম খেয়ে বলেন-
‘এই কাজের উদ্দেশ্য হলো- (মুসলিম) উম্মাহকে ঐ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়াতের ২৩ বছরে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে গেছেন। দাওয়াতের কাজকে আমি সে পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। এটাই দাওয়াতের মাকসাদ।’
ইলিয়াস রহ. বলতেন, এই মেহনতের দ্বারা আমার তিনটি মাকসাদ-
>> আল্লাহর ছাড়া যা কিছু আমার দিলে (অন্তরে) রয়েছে, তার প্রভাব যেন দূরে চলে যায়।
>> দুনিয়ার সমস্ত চাকচিক্য থেকে আমার অন্তর যেন বেজার হয়ে যায়। এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নতের গুরুত্ব আমার অন্তরে মজবুত করে যেন বসে যায়।
কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো প্রোডাক্টের ফজিলত বলেননি বরং তিনি আমলের ফাজায়েল বর্ণনা করেছেন।
>> দুনিয়ায় কোনো কিছু উপর যেন দৃষ্টি না পড়ে। বরং দৃষ্টি যেন আখেরাতের উপর পড়ে। কারণ এই দুনিয়া টিকে থাকবে না৷ বরং তা ক্ষণস্থায়ী। আর আখেরাত চিরস্থায়ী।
সব উম্মতের মাঝে যেন এই তিন মাকসাদ (লক্ষ্য-উদ্দেশ্য) এসে যায়, এটাই ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহির মাকসাদ ছিলো। কোনোভাবে কষ্ট করে যদি এই তিন মাকসাদ আমরা হাসিল করতে পারি তাহলে আখেরাতে চিরস্থায়ীভাবে আমরা জান্নাতে থাকতে পারবো, ইনশাআল্লাহ।
এমএমএস/এমএস