জুমআতুল বিদা : ঈদের আগে আরেক ঈদ

ধর্ম ডেস্ক
ধর্ম ডেস্ক ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৪১ পিএম, ৩০ মে ২০১৯

এসএম আনওয়ারুল করীম
জুমআআতুল বিদা মুসলিম সংস্কৃতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ দিবস। জুমআআতুল বিদা আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো সমাপনি সম্মিলন। ইসলামের পরিভাষায় সিয়াম সাধনার মাস রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘জুমআআতুল বিদা’ বলে। এ দিবসকে এতদঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মানুষ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একে কেন্দ্র করে প্রতিটি মুসলিম মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। বলতে গেলে দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা শেষে মুসলিম মনে যে ঈদ-উল- ফিতরের আগমন ঘটে, তারই আগাম জানান দেয় জুমআআতুল বিদা।

বস্তুত ইসলামি সংস্কৃতির একটি বিরাট অংশ দখল করে আছে জুমআ দিবস। প্রতি সপ্তাহের জুমআ দিবসে মুসলিম মনে এক জাগরণ সৃষ্টি হয়। এ জাগরণে অংশগ্রহণ করে পরবর্তী সপ্তাহের কর্মকৌশল ও কর্তব্য স্থির করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি ছুটি পালন হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও শুক্রবার সাপ্তাহিক সরকারি ছুটি পালন হয়ে আসছে। এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে থাকে অনেক বিনোদন, অনেক আসর-আড্ডা।

জুমআর দিনের গুরুত্ব ও মর্যাদার সহজ উপমা হলো- এ দিবসকে কেন্দ্র করে পবিত্র কুরআনে ‘জুমআ’ নামে স্বতন্ত্র একটি সুরা নাজিল করা হয়েছে। ‘জুমআআতুল বিদা’ তন্মধ্যে যেন সোনায় সোহাগা। এক হাদিসে জুমআর দিবসকে সাপ্তাহিক ঈদস্বরূপ বলা হয়েছে। সে হিসেবে প্রতি বছরের বড় দুটি ঈদ তথা ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহার আগমনীবার্তা ঘোষণা করার জন্য প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার মিলে মোট বায়ান্নটি দিবস নির্ধারিত রয়েছে। তন্মধ্যে সবচে গুরুত্বের দাবিদার ‘জুমআআতুল বিদা’। জুমআআতুল বিদাকে সকল জুমআর সেরা জুমআ বলা হয়।

আমাদের দেশে দীর্ঘ এক মাসের রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের পয়গামধন্য রমজান মাস শেষে পশ্চিমাকাশে যে চিকন বাঁকা চাঁদ উদিত হয়, তাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি মানুষের মনে ঈদের আনন্দের ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। এ উপলক্ষে প্রতিটি মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোশাক-পরিচ্ছেদ কেনা-কাটা করে।

ঈদের দিন সেমাই-ফিরনির সুঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ করে। মূলতঃ ঈদ-উল-ফিতরের সকল আনন্দের ধারা শুরু হয় জুমআআতুল বিদা তথা রমজানের শেষ শুক্রবার থেকেই। জুমআআতুল বিদার আলোচনায় মসজিদের ইমাম-খতিবগণ যখন রমজানকে বিদায় জানানোর ইঙ্গিতবাহী বক্তব্য প্রদান করেন, তখন থেকেই শ্রোতাদের মন ঈদের কেনা-কাটা ও আনন্দের জন্যে উসখুস করতে শুরু করে।

নামাজ শেষে নতুন করে হিসেবের পালা শুরু হয় ঈদকে নিয়ে। ঈদের বাজার নিয়ে এতদিন যে গুঞ্জন মনের গভীরে ছন্দপতন ঘটাত, ঐদিন তা প্রকাশ্যে রূপ নেয়। ঈদের কেনাকাটার চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হয়।

জুমআআতুল বিদা তথা রমজানের শেষ জুমআয় আমাদের দেশের প্রতিটি মসজিদে মুসল্লিদের উপচেপড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়। এদিন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের উল্লেখযোগ্য বড় বড় মসজিদগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না।

নামাজি মুসল্লিরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মূল মসজিদসহ আশপাশের আঙিনা ও রাজপথে কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়ায়। অনেক স্থানে এমনও দেখা যায় যে, ঈদের জামাআতের চাইতেও জুমআআতুল বিদার জামাআত বড় হয়ে পড়ে।

জুমআআতুল বিদার বড় জামাআতে অংশগ্রহণ করাকে দেশের প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষই বড় পুণ্যের ইবাদত মনে করে থাকে। ফলে গ্রাম কিংবা মফস্বল এলাকার বহু ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটে আসে শহরের বড় বড় মসজিদের জুমআআতুল বিদার জামাআতে শরিক হতে।

আতর-গোলাপের সুঘ্রাণ, সাদা পোশাক, মাথায় টুপি মিলে যেন এক বেহেশতি দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। ঈদের আগে এ যেন এক ভিন্ন রকমের ঈদ। অবস্থা এমন ঘটে যে, মুসলিম বিশ্বে ঈদ দুটি নয় তিনটি।

ইসলামে জুমআআতুল বিদা’র সরাসরি গুরুত্ব বহনকারী কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও একে কেন্দ্র করে প্রতিটি যুগের মানুষের মাঝেই একটা ফুরফুরে ভাব তৈরি হতো। প্রতিটি যুগের মুসলমানরাই জুমআআতুল বিদাকে ভিন্নভাবে গুরুত্ব দিত।

তবে হাদিসে সাধারণ জুমআ দিবসের যেই গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে, জুমআআতুল বিদার ফজিলত যে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি, তা যৌক্তিকভাবেই বলা যায়। হাদিসে এমনও বর্ণনা পাওয়া যায় যে, রাসূলুল্লাহ (স) জুমআআতুল বিদার খোতবায় ‘আল-বিদা-আল বিদা’ শব্দ উচ্চারণ করতেন।

বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জবানিতে এ শব্দ শোনার পর সাহাবায়ে কেরাম বিলাপ ধরে কান্না শুরু করতেন। তারা বলতেন রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের বার্তাবাহী মাস রমজানকেই মূলত জুমআআতুল বিদায় সম্ভাষণ জানানো হয়েছে।

পরবর্তী রমজান ভাগ্যে জুটে কিনা এবং রমজানের মতো ক্ষমাপ্রাপ্তির মাসেও আমাদের বরাতে ক্ষমা জুটেছে কিনা- এসব আফসোসেই সাহাবায়ে কেরাম কান্নায় ভেঙে পড়তেন। প্রকৃতপক্ষে জুমআআতুল বিদার আগমন মানেই পুণ্যের মাস রমজানকে বিদায় জানানো।

তাফসিরের কিতাবসমূহে জুমআ দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা নভোমণ্ড, ভূমণ্ডল ও সমস্ত জগতকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই ছয়দিনের শেষ দিন ছিল জুমআর দিন।

এ দিনেই আদি মানব হযরত আদম (আ) সৃজিত হন, এ দিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং এ দিনেই তাকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামানো হয়। কেয়ামত এ দিনেই সংঘটিত হবে। জুমআ দিবসে এমন একটি মুহূর্ত আসে, যাতে মানুষ যে দোয়াই করা হয়, তাই কবুল হয়।

আল্লাহ তাআলা প্রতি সপ্তাহে মানবজাতির সমাবেশ ও ঈদের জন্যে জুমআ দিবস রেখেছিলেন। কিন্তু পূর্ববর্তী উম্মতরা তা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ইহুদিরা ইয়াওমুস সাবত তথা শনিবারকে নিজেদের ইবাদতের দিন নির্ধারিত করে নেয়। খ্রিস্টানরা নেয় রোববারকে।

তাফসিরে ইবনে কাসিরের বর্ণনা মতে, অজ্ঞতার যুগে শুক্রবারকে ইয়াওমে আরূবা বলা হতো। আরবে কাব ইবনে লুওয়াই সর্বপ্রথম এর নাম ‘ইয়াওমুল জুমআ’ রাখেন। এ দিবসে কুরাইশরা সমাবেশ হতো এবং কাব ইবনে লুয়াই এ সমাবেশে ভাষণ দিতেন। এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের ৫৬০ বছর আগের ঘটনা।

কাব ইবনে লুয়াই তার ভাষণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের সুসংবাদও মানুষকে শুনিয়েছিলেন। সারকথা এই যে, ইসলামের আগমনের আগে কাব ইবনে লুয়াইর আমলেও শুক্রবার দিনকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। (মাজহারি)

জুমআআতুল বিদাকে কেউ কেউ আখেরি জুমআও বলে থাকেন। রমজান মাসের শেষ জুমআকে কবে থেকে জুমআআতুল বিদা নামে নামকরণ করা হয়েছে, তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ঐতিহাসিক সূত্রমতে, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের রমজান মাস ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের শেষ রমজান। ঐ রমজান মাসের শেষ জুমআতেই প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দেয়া খোতবায় দু’বার ‘আল বিদা’ বলেন।

এ শব্দ উচ্চারণ করে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম তার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। অর্থাৎ এটিই ছিল তার জীবনের সর্বশেষ রমজান মাস। পরবর্তী বছরের রবিউল আউয়াল মাসেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। তাই ঐ খোতবায় তিনি রমজানকে বিদায় জানাতে গিয়ে উম্মতের কাছ থেকে নিজের বিদায় হবার ঘোষণাই দিয়েছিলেন।

ইতিহাসে এমনও রয়েছে যে, ঐ বছর প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খোতবায় ব্যতিক্রমী ‘আল বিদা’ শব্দটি শোনার পরই প্রধান সাহাবী হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ফুঁফিয়ে কেঁদে ওঠেন। সাহাবায়ে কেরাম তার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রস্থান আর বেশি দূরে নয়।’ মূলত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখনিসৃত ‘আল বিদা’ শব্দ থেকেই পরবর্তীতে রমজানের শেষ জুমআকে জুমআআতুল বিদা বলা হয়ে আসছে।

তাফসিরে ইবনে কাসিরের বর্ণনা মতে, জুমআর দিনে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, সে সময় যে দোয়াই করা হয়, তাই কবুল হয়। সহিহ হাদিসে এ কথা প্রমাণিত রয়েছে।

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, কোনো ধর্মীয় মজলিসে যদি অন্তত চল্লিশজন লোক একত্রিত হয়ে কোনো দোয়া করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে যে কোনো একজনকে অলির মর্যাদা দিয়ে তার সঙ্গে সকলের দোয়া কবুল করে নেন।

জুমআআতুল বিদার বিশাল জামাআতে আমাদের দেশের বিভিন্ন মসজিদে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাই ঐ দিনের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আর সাধারণ জুমআর দিনেই সেখানে নির্দিষ্ট মুহূর্ত যে কোনো দোয়া করা হয়ে থাকে, সেখানে জুমআআতুল বিদায় তো এ ফজিলত আরও উন্মুক্ত হওয়াই যুক্তিযুক্ত।

হাদিসের অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, রমজান মাসে প্রতিদিন ইফতারপূর্ব সময়ে আল্লাহ তাআলা সত্তর হাজার গোণাহগারকে ক্ষমা করে দেন। এ হিসেবে সমগ্র রমজানে যেই পরিমাণ গোনাহগারকে ক্ষমা করা হয় শুধুমাত্র জুমআআতুল বিদা তথা আখেরি জুমআয় সেই সংখ্যক ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয়। তাই এ দিনে প্রাণ খুলে আল্লাহর দরবারে রোজাদার ব্যক্তির প্রার্থনা করা উচিত।

লেখক : আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন; বিভাগীয় প্রধান (হাদীস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স
[email protected]

এমএমএস/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।