কে এই তালেবানদের আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা সামিউল?

ধর্ম ডেস্ক
ধর্ম ডেস্ক ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:০৩ পিএম, ০৩ নভেম্বর ২০১৮

বিশ্বে ‘ফাদার অব দ্য তালেবান’ খ্যাত মাওলানা সামিউল হক (৮১) গতকাল ২ নভেম্বর আততায়ীর হাতে ছুরিকাঘাত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার মৃত্যুতে পাকিস্তান সরকার প্রধানসহ সাবেক-বর্তমান অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি ও আলেম শোক প্রকাশ করেন।

মাওলানা সামিউল হককে তালেবান আন্দোলনের প্রধান নেপথ্য পুরুষ হিসেবেও গণ্য করা হয়। কারণ এ আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের শিক্ষক ছিলেন তিনি। মাওলানা সামিউল হক পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা ও পাকিস্তান সিনেটের সাবেক সদস্যও ছিলেন। শেষ বয়সে পাকিস্তানে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।

পাকিস্তানে তালেবান আন্দোলনের সঙ্গে মাওলানা সামিউল হকের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তার পরিচালিত দারুল উলুম হাক্কানিয়া মাদরাসায় পাকিস্তান সরকার কখনো কোনো হস্তক্ষেপ করেনি বরং মাদরাসা পরিচালনায় পাকিস্তানের আঞ্চলিক সরকার রাষ্ট্রীয় অর্থও বরাদ্দ দিতো।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের শীর্ষ তালেবান নেতাদের এ আধ্যাত্মিক উস্তাদের মৃত্যুতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শোক প্রকাশ করে বলেন, নিঃসন্দেহে পাকিস্তান একজন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নেতা হারিয়েছে। এ শূন্যতা পূরণীয় নয়। মাওলানা সামিউল হকের ত্যাগ ও অবদান মানুষ সবসময় স্মরণ রাখবে। পাশাপাশি তিনি মাওলানা সামিউল হকের ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় তালেবানদের সঙ্গে প্রস্তাবিত আলোচনার যে মিশন শুরু হয়েছিল সেটিরও নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা সামিউল হক। তিনি বলেন, দেশের একজন বিশিষ্ট আলেমের এভাবে শহিদ হওয়া বড়ই দুঃখের বিষয়। এর উপযুক্ত বিচার হওয়া দরকার।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান বলেন, আমি তার মাদরাসা দারুল উলুম হাক্কানিয়াতে ৮ বছর পড়াশোনা করেছি। তিনি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আমি তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে পাকিস্তানের এক সময়ের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল ভালো।

১৯৩৭ সালে জন্ম নেয়া মাওলানা সামিউল হক পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের আফগানিস্তান সীমান্তের কাছে ১৯৪৭ সালে গড়েন দারুল উলুম হাক্কানিয়া মাদরাসা। তিনি এ মাদরাসার পরিচালক ছিলেন।

মানুষ এ দারুল উলুম হাক্কানিয়াকে ‘জিহাদ বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবেই বেশি চিনে। তিনি ৪০টির বেশি সংগঠনের জোট ‘দিফা-ই-পাকিস্তান’ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন।

২০১৩ সালে পোলিও ভ্যাকসিনের সমর্থনে মাওলানা সামিউল হক পাকিস্তানে ফতোয়া জারি করেন।

মাওলানা সামিউল হকের বক্তৃতা ছিল চমৎকার। মানুষ তার বক্তৃতা শোনার জন্য ভিড় করতো। মঞ্চে উঠলে তাকে আর চেনা যেতো না। তার চেতনা আর ধারালো বক্তৃতায় পাগল হয়ে যেত মানুষ।

তালেবানের এ আধ্যাত্মিক গুরু মতাদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে বিবিসি রেডিওতে অংশগ্রহণ করতেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের হামিদ হকের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ বা বক্তব্য পাঠাতেন।

তালেবান নেতা মোল্লা ওমর, আমির খান মক্কি, মাওলানা আহমদ জং, মোল্লা খায়রুল্লাহ খায়েরসহ অনেক তালেবান শীর্ষ নেতা তার ছাত্র ছিলেন। এখনও আফগানিস্তানের অনেক ছাত্র তার মাদরাসায় পড়ছে।

শেষ বয়সে তার জনপ্রিয়তা বেশি হয়ে ওঠেছিল। রাজনৈতিক ও মতাদর্শগতভাবে বিভিন্ন ইসলামী কাজে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

রক্ষণশীল ইসলামিক রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে মতাদর্শের দিক দিয়ে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তিনি একজন শিক্ষক। দারুল উলুম হাক্কানিয়ার প্রিন্সিপাল। বহু ছাত্র তৈরি করে গেছেন তিনি। হাজার হাজার তালিবে ইলম তার মাদরাসা থেকে ইলম অর্জন করেন।

২০০৩ সালে আফগানিস্তানকে রাশিয়া হুমকি দিলে মাওলানা সামিউল হক আফগানিস্তানে তার ছাত্রদের তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করেন।

পশতু ভাষায় দেয়া সে বক্তৃতায় তিনি বলেন, অতীতে কেবলমাত্র ইসলামের অবসান ঘটানোর জন্য হুমকি এসেছিল; এখন হুমকি এসেছে মুসলিম ও ইসলাম, মসজিদ ও মাদরাসাকে বিলীন করার জন্য। তাই আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।

অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাশিয়ার মতো পরাশক্তির বিরুদ্ধে তালেবানরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

আফগানিস্তানে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করলে পাকিস্তানের সহযোগিতা চাইলে মাওলানা সামিউল হকের পরামর্শে পাকিস্তানের তালেবানরা তাদের সহযোগিতা করেছিল।

মৃত্যুর একদিন আগেও মাওলানা সামিউল হক খাইবার পাখতুনখোয়া এর চরসাদ্দা জেলার টঙ্গি অঞ্চলে একটি সম্মেলনে তার শেষ বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত তার ছাত্র ও অনুসারীরা জিহাদের ওপর তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

মাওলানা সামিউল হকের ছেলে মাওলানা হামিদুল হক জানান, মরহুমের মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তার জন্মস্থান খাইবার পাখতুনখোয়ার নওশেরা জেলায় নেয়া হয়েছে। সেখানেই জানাজা শেষে তার মরদেহ দাফন করা হবে।

এমএমএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।