বৃদ্ধাশ্রমই কী প্রবীণদের আসল ঠিকানা?
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশেও বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালিত হয়েছে। আজ (১ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস।
‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রবীণদের স্মরণ পরম শ্রদ্ধায়’ স্লোগানেই এবার প্রবীণ দিবসকে বিশেষায়িত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য প্রবীণদের প্রতি পরম মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাড়ানো।
ছেলে-মেয়ের হাতে গর্ভধারিণী মাকেও নির্যাতিত হতে হয়। চরম অবহেলা ও নির্যাতন সইতে হয়। নড়াইলের লোহাগড়ায় ৯০ বছরের বৃদ্ধা মা ফুজলি বেগমকে বাঁশবাগানে ফেলে দিয়েছে ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। অথচ এ মা তার ৫ সন্তানকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। তারাই আজ বৃদ্ধা মায়ের দায়িত্ব নিতে চান না।
১৯৯০ সালের ১ অক্টোবর থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে এই দিবসটি প্রতি বছরই বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। সমাজে সচেতনা বাড়াতে প্রতি বছরই নতুন নতুন স্লোগান দেয়া হয়। বয়সে যারা বুড়ো, প্রবীণ; তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেখানোর জন্যই এ দিবসটি পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তারপরও প্রবীণদের সঙ্গে ঘটছে নানা অঘটন।
কুরআন ও হাদিসে প্রবীণদের প্রতি যত্ন নেয়ার বিষয়ে রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। কেননা প্রবীণদের প্রতি উত্তম আচরণ ইসলামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা সন্তানদের তাদের মা-বাবার প্রতি বৃদ্ধাবস্থায় আচরণ সম্পর্কে ঘোষণা করে বলেন-
‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিচ্ছে, তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তোমাদের কাছে যদি তাদের কোনো একজন অথবা উভয়ই বৃদ্ধাবস্থায় পৌঁছে, তাহলে তাদের (তুমি এমন কোনো কথা বলবে না, যে কথা শুনে তারা) ‘উহ্’ পর্যন্ত বলবে না, তাদের ধমক দেবে না। বরং তাঁদের সঙ্গে বিশেষ মর্যাদাসহকারে সম্মানজনক কথা বলবে। বিনয় ও নম্রতার বন্ধনে তাদের আবদ্ধ করবে। আর এ দোয়া করতে থাকবে- ‘হে প্রভু, তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, যেমন করে তারা স্নেহ-মমতাসহকারে শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে।’ (সুরা ইসরা : আয়াত ২৩-২৪)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবীণদের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও সেবা যত্ন করার বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-
> ‘যে ব্যক্তি একজন বয়োবৃদ্ধের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে কিয়ামতের দিন সব ভয়ভীতি ও আশংকা থেকে নিরাপদ রাখবেন।’
অন্য হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন বার বললেন, ধূলায় অবলুণ্ঠিত হোক তার নাক। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাস করেন, কার নাক? হে আল্লাহর রাসূল!, তিনি বললেন, সেই ব্যক্তির যে তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার একজনকে অথবা উভয়কে পেল। অতপর তাদের খিদমত করে জান্নাত লাভ করতে পারল না। (মুসলিম)
প্রবীণ ও জ্ঞানী লোকের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাতে নসিহত পেশ করেছেন হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বলেছেন-
‘জ্ঞানীকে তার জ্ঞানের জন্য, বৃদ্ধকে তার বয়সের জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হবে।’
ইসলামের নির্দেশনা হলো প্রবীনদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করা আর ছোটদের স্নেহ করা। সুতরাং বিশ্বের সব প্রবীণ ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা ও সম্মানে অভিষিক্ত করার পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারের সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
প্রবীণদের প্রতি অবহেলা এড়াতে করণীয়
বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। সে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও। বিদেশিদের অনুকরণে দেশে ব্যাপক হারে বৃদ্ধাশ্রম অবাধে বাড়তে থাকলে হাজার বছরের পারিবারিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ, স্নেহ-প্রীতি, মায়া-মমতার বন্ধন ধ্বংসের পথে ধাবিত হবে। বিলুপ্ত হবে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান ও ভালোবাসা। আর নিঃসন্দেহে মানুষের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে ধ্বংস এবং আজাব পতিত হবে।
সুতরাং প্রবীণদের সেবা-যত্নের প্রতি গুরুত্ব দিতে সচেতন হওয়া ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরি। সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যশ-খ্যাতি ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে না তোলে প্রবীণদের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করাই হোক সময়ের দাবি।
বিশেষ করে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা বৃদ্ধিতে মানুষের মাঝে সচেতনা বাড়াতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াগুলোতে সব সময় কার্যকর ভূমিকা তথ্যচিত্র নির্মাণ করা জরুরি। এমনকি প্রবীণদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন প্রণয়ন করাও সময়ের দাবি।
বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণে বিরোধিতা নয়, বরং বৃদ্ধাশ্রম হবে একেবারেই উপায়ন্তরহীন লোকদের জন্য। যেসব প্রবীণদের খোঁজ-খবর নেয়ার মতো কোনো স্বজন নেই, তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে হতে পারে সেবাশ্রম।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না
আজ যারা তারুণ্যদীপ্ত রঙিন জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে বৃদ্ধ পিতামাতাসহ প্রবীণদের প্রতি অবহেলা করছে। প্রবীণদেরকে ঝামেলা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমের নিঃসঙ্গ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমন দিনও আসতে পারে, যেদিন তারাও তাদের সন্তানদের দ্বারা বৃদ্ধাশ্রমে নির্বাসিত হতে পারে। কিংবা তারা অত্যাচার নির্যাতনের সম্মুখীন হবে।
তাই নিজের পিতামার প্রতি যথাযথ সেবা-যত্ন করুন। নিজ সন্তানকে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও কুরআনের অনুপম আদর্শ শিক্ষা দিন। যে শিক্ষা সন্তানকে পশুত্ব থেমে মানবতার দিকে নিয়ে আসবে। নির্মিত হবে সুন্দর পরিবার ও সমাজ। আর তাতেই বৃদ্ধ মা- বাবাসহ প্রবীণদের পরিপূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
আর বৃদ্ধ মা-বাবাসহ প্রবীণদের জন্য আল্লাহর শেখানো ভাষায় সবসময় এভাবে দোয়া করুন-
رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
উচ্চারণ : ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’
অর্থ : ‘হে প্রভু, তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, যেমন করে তারা স্নেহ-মমতাসহকারে শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে।
প্রবীণদের মর্যাদা রক্ষার সব উপদেশ ও দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো ঘরে ঘরে পৌঁছে সবার কাজ করা উচিত। আর এ সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যক্তি পরিবার সমাজ তথা রাষ্ট্রকে সার্বিকভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে একদিন প্রবীণ পালন না করে প্রতিদিন বৃদ্ধ মা- বাবাসহ প্রবীণদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর