আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থার মূর্তপ্রতীক বিবি হাজেরা
মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন হজরত হাজেরা আলাইহিস সালাম। তিনি মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের স্ত্রী এবং পয়গাম্বর হজরত ইসমাইল জবিহুল্লাহর মাতা।
আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলেন তাঁর প্রিয় ও পবিত্র ভূমি মক্কা নগরীকে জনবসতি ও আবাদ করবেন। সে আলোকে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে নির্দেশ দিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় দুগ্ধপোষ্য শিশু সন্তান হজরত ইসমাইল ও স্ত্রী হজরত হাজেরাকে জনমানবহীন মরুপ্রান্তর রেখে আসার জন্য।
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশ পালন করলেন। আবাদ হলো পবিত্র নগরী মক্কা। জেনে নেয়া যাক সংক্ষেপে সে ঘটনা-
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম মিসর থেকে কেনআনে আসার বৎসরাধিককাল পরে প্রথম সন্তান ইসমাঈলরে জন্ম লাভ হয়। হজরত ইসমাইলের জন্মের কিছুদিন পরেই প্রাণপ্রিয় শিশু সন্তান ও তার মা হাজরোকে মক্কার জনশূন্য মরুপ্রান্তরে রেখে আসার নির্দেশ পান। এটা ছিল হজরত ইবরাহিম ও হজরত হাজেরার জন্য মর্মান্তিক ও মহা পরীক্ষা।
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশু পুত্র ইসমাঈল ও তার মাকে মক্কায় নির্বাসনের নির্দেশ পান; তখনই তার অন্তরে এ বিশ্বাস জন্মেছিল যে, নিশ্চয়ই এতে মহান আল্লাহর কোনো মহতি মহাপরিকল্পনা রয়েছে। নিশ্চয় তিনি শিশু ইসমাইল ও তাঁর মাকে ধ্বংস করবেন না।
অতঃপর হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এক থলে খেজুর ও এক মশক পানিসহ বর্তমান ফিলিস্তিনের খলিল শহর থেকে জনশূন্য প্রান্তরে রেখে আসলেন।
তাদেরকে রেখে যখন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম শামদেশের উদ্দেশ্যে রহওয়ানা করলেন তখন হজরত হাজেরা বেদনা বিস্মৃত হয়ে ব্যাকুলভাবে তার পিছে পিছে আসতে লাগলেন। আর জানতে চাইলেন আপনি এখানে আমাকেদেরকে একাকি রেখে যাচ্ছেন? হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কোনো জবাব দিচ্ছিলেন না।
যখন হজরত হাজেরা বললেন, আপনি কি আল্লাহর নির্দেশ পালনে আমাদেরকে একাকি রেখে যাচ্ছেন। তখন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ইশারায় বললেন, ‘হ্যাঁ’।
আল্লাহর নির্দেশের কথা শুনে হজরত হাজেরা বললেন, ‘তাহলে আল্লাহ তাআলা আমাদের ধ্বংস করবেন না।’ এরপর তিনি সন্তানের কাছে ফিরে আসলেন। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে হজরত হাজেরা সেখানেই বসবাস করতে লাগলেন। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম চলে যাওয়ার সময় দোয়া করলেন-
‘হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার পবিত্র ঘরের নিকটে এমন এক ময়দানে আমার স্ত্রী ও পুত্রকে রেখে যাচ্ছি, যা (অনাবাদি) শস্যের অনুপযোগী এবং জনশূন্য (নির্জন প্রান্তর) মরুভূমি।
হে প্রভু! এ উদ্দেশ্যে (তাদের উভয়কে রেখে যাচ্ছি) যে, তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে। অতএব তুমি লোকদের মনকে এ দিকে আকৃষ্ট করে দাও এবং প্রচুর ফল ফলাদি দ্বারা এদের রিযিকের ব্যবস্থা করে দাও। তারা যেন তোমার শুকরিয়া আদায় করতে পারে।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৩৭ ; বুখারি)
অতঃপর হজরত হাজেরা ক্ষুধা লাগলে খেজুর খেয়ে পানি পান করে নিতেন আর শিশু ইসমাইলকে দুধ পান করাতেন। ধীরে ধীরে মশকের পানি শেষ হয়ে যায়। শিশুসন্তান ইসমাইলসহ তাঁর পিপাসা বাড়তে থাকে।
শিশু ইসমাইলের পিাপাসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মা হাজেরার পেরেশানি বেড়ে যায়। পানির সন্ধানে তিনি চারদিকে ছুটোছুটি শুরু করেন।
দৌড়ে গিয়ে প্রথমেই পার্শ্ববর্তী ‘সাফা’ পাহাড়ে আরোহন করলেন। চারদিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলেন কোথাও পানির সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। কোনো সন্ধান না পেয়ে পার্শ্ববর্তী ‘মারওয়া’ পাহাড়ে আরোহন করলেন।
এ সাফা ও মারাওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানটা কিছুটা সমতল ছিল। যে কারণে পাহাড় থেকে নামার সময় শিশু ইসমাইলকে দেখা যেত। যখনই দুই পাহাড়ের পাদদেশে সমতল ভূমিতে যেতেন তখন আর তাকে দেখা যেত না। এ কারণে হজরত হাজেরা সমতল স্থানটা দ্রুত অতিক্রম করতেন। এভাবে তিনি সাফা থেকে মারওয়া; মারওয়া থেকে সাফায় সাত বার অতিক্রম করেন। এ কাজটি আল্লাহর কাছে পছন্দ হয়ে যায়। তাই আল্লাহ তাআলা হজ ও ওমরা পালনকারীদের জন্য ‘সাফা-মারওয়ার’ সাঈ-কে রুকন করে দিয়েছেন।
সাফা-মারাওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ির সপ্তম বা শেষ বার তিনি শিশু ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে দেখতে পান তাঁর পায়ের কাছ থেকে পানির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে।
হজরত হাজেরা দ্রুত মারওয়া পাহাড় থেকে শিশু ইসমাইলের কাছে ছুটে আসলেন। তাঁকে অসীম মমতায় কোলে তুলে নিলেন এবং আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলেন। পানির উৎসের চারদিকে বাধ দিয়ে পানি আটকাতে লাগলেন। পানি দিয়ে মশক ভরে নিলেন। শিশু ইসমাইলকে পানি পান করালেন এবং নিজেও পান করলেন।
এটি ছিল ঝমঝমের পানি। এ পানি হজরত জিবরিল আলাইহিস সালামের পা অথবা ডানার আঘাতে সৃষ্টি হয়েছিল।
হঠাৎ হজরত হাজেরা অদূরে একটি আওয়াজ শুনে চমকে উঠলেন। এ আওয়াজ ছিল হজরত জিবরিল আলাইহিস সালামের। তিনি বলেন উঠলেন-
‘আপনারা ভয় পাবনে না (ঘাবড়াবেন না)। এখানইে আল্লাহর ঘর রয়েছে। এই সন্তান ও তার পিতা উভয়ে মিলে এ ঘর নির্মাণ করবেন। আল্লাহ তাঁর ঘরের অধিবাসীদের ধ্বংস করবেন না।’ বলে শব্দ মিলিয়ে গেল।’
অতঃপর শুরু হল হজরত হাজেরা ও শিশু ইসমাইলের জীবনের নব অধ্যায় শুরু হলো। পানি দেখে পাখি আসলো। পাখির উড়া-উড়ি দেখে ব্যবসায়ী কাফেলা আসলো। তারা এসে পানির মালিক হিসেবে হজরত হাজেরার কাছে পানি লাভের অনুমতি চাইল। তিনি ব্যবসায়ীদেরকে বসতি স্থাপনের শর্ত সাপেক্ষে পানি দানের অনুমতি দিলেন। তারা বিনা পয়সায় এ প্রস্তাব পেয়ে সাদরে গ্রহণ করলেন।
এভাবেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জনমানবহীন মরুপ্রান্ত জনবসতি গড়ে উঠল। এরাই ইয়েমেন থেকে আগত বনু জোরহাম গোত্রের লোক। শিশু ইসমাইল বড় হয়ে এ গোত্রে বিবাহ করেন। তাঁরাই কাবা ঘরের খাদেম হন এবং এ গোত্রের শাখা গোত্র কুরাইশ বংশে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ও রাসুল হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেন।
অতঃপর হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম পুনরায় আগমন করলেন। আল্লাহর নির্দেশে পিতা তার পুত্রকে কুরবানির ইচ্ছা পোষণ করলেন। শিশু ইসমাইল তাতে সায় দিলেন। আল্লাহর দরবারে দুম্বার বিনিময়ে কুরবানি কবুল হয়ে গেল। পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এবং পুত্র ইসমাইল উভয়ে মিলে পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণ করলেন।
শিক্ষণীয় বিষয়
>> ইবরাহীম (আঃ) তাঁর স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে জনমানব শূন্য ও চাষাবাদহীন শুষ্ক মরুভূমিতে রেখে আসলেন; আর বিবি হাজেরা চরম ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে কেয়ামত পর্যন্ত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন। আল্লাহর ঘোষণা- তার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনকারীকে তিনি ধ্বংস করবেন না।
>> হজরত ইবরাহিমের দোয়া আল্লাহ তাআলা দ্রুত কবুল করেছিলেন। সেখানে তৈরি হয় ঝমঝম পানির ফোয়ারা। খাদ্য চাহিদার এমন কোনো গুণ নেই যা ঝমঝমের পানিতে নেই। যা মানুষের খাদ্য ও পানীয় উভয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
>> ব্যবসায়ী সম্প্রদায় দ্বারা জনবসতিপূর্ণ হয় পবিত্র ভূমি। সারা দুনিয়া থেকে ফল-ফলাদি আমদানি হয়ে আসে এ পবিত্র ভূমিতে। এ এক অতুলনীয় শহর। নিঃসন্দেহে এটা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দোয়ার বরকত।
>> হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দোয়া ছিল- ‘আমার স্ত্রী ও সন্তানকে এখানে রেখে যাচ্ছি; তারা এখানে নামাজ কায়েম করবে। আল্লাহর রহমতে এটা এমন এক স্থানে পরিণত হয়েছে যে, পবিত্র বায়তুল্লায় মুহূর্তের জন্য সময়েও নামাজ ও আল্লাহর স্মরণ থেকে মুক্ত থাকে না।
>> তিনি দোয়ায় আরো বলেছিলেন যে, ‘মানব সমাজরে কছিু অংশরে হৃদয়কে তুমি এদরে প্রতি ঝুঁকিয়ে দাও। আল্লাহ তাআলা সারা দুনিয়ার সব মানুষকে এ ঘরের দিকে না ঝুকিয়ে তাঁর নির্বাচিত উত্তম লোকদেরকেই কাবার বাসিন্দা হিসেবে কবুল করেন। আর যদি সারা বিশ্বের মানুষের জন্য বাসিন্দা হওয়ার দোয়া করতে তবে সেখানে স্থান সংকলন করাই অসম্ভব হয়ে যেত।
পরিশেষে...
মুসলিম উম্মাহর নারী সমাজের একটা বিষয় লক্ষ্য করা উচিত যে, হজরত হাজেরা আলাইহিস সালামের অন্তরে আল্লাহর প্রতি কত গভীর আস্থা এবং ভরসা ছিল। তিনি যখন জানতে পারলেন যে, এই নির্জন মরুভূমিতে আল্লাহর নির্দেশেই তাঁকে রেখে যাওয়া হচ্ছে, তখন তিনি চিন্তামুক্ত হয়ে গেলেন এবং সম্পূর্ণ আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে সেখানে থাকতে লাগলেন।
আর আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসার কারণেই আল্লাহ তাআলা অতি দ্রুত তাকে ঝমঝমের বরকত এবং উত্তম লোকের বসতি স্থাপনসহ সারা দুনিয়ার মানুষের এ পবিত্র ভূমিকে হৃদয়ের আকর্ষণে পরিণত করলেন।
সুতরাং কোনো পেরেশানি বা বিপদ আসলে ঘাবড়ে না যেয়ে; মহান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা বিশ্বাসের সঙ্গে সাহায্য প্রার্থনা করি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব নারী-পুরুষকে তাঁর ওপর সব বিষয়ে আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা করার তাওফিক দান করুন। পরকালের উত্তম জীবন লাভে তাঁর নির্দেশ যথাযথ পালন করার তাওফিক দান করুন। সব নারীদেরকে হজরত হাজেরার অগাধ ভরসার নমুনা নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম