প্রবাসে লক্ষ্মী পূজার নাড়ুর খোঁজে

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০২:০০ এএম, ১৭ অক্টোবর ২০২৪
রিনা ভাবীর মায়ের হাতের নাড়ু

চর এলাকায় শস্য উৎপাদন ছাড়া ফলমূল তেমন একটা হয় না তবে যে ফলের গাছ কয়েক বছরের ব্যবধানেই ফল দেয় যেমন কুল, পেয়ারা, আতা, কলা এগুলো পাওয়া যায় কিন্তু আম জাম কাঁঠাল নারিকেলের গাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। অবশ্য পুরোনো চর ভেঙে গেলে নতুন চরে এসে বসতি গড়ার পর সময়ও লাগে গাছগুলো বড় হয়ে উঠতে তাই আম, জাম, কাঁঠাল বা নারিকেল গাছ লাগানো হলেও তখন পর্যন্ত সেগুলো ফল দেওয়া শুরু করেনি তাই হাট থেকে কিনে এনে সেগুলো খাওয়া হয় বা সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করে পরিবেশন করা হয়।

বছরের একটা সময় হাট থেকে নারিকেল কিনে আনা হতো নাড়ু তৈরি করার জন্য। সেই নারিকেলগুলোর মধ্যে কিছু কিছুর বয়স অনেক বেশি হয়ে যাওয়াতে তার মধ্যে ফোঁপরা গজিয়ে যেতো। হলুদাভ রঙের তুলতুলে ফোঁপরা খেতে দারুণ। আমরা ছোটরা সেটা বাটিতে নিয়ে খেয়ে বেড়াতাম। তবে নারিকেল দিয়ে বানানো যে জিনিসটার জন্য আমরা সারা বছর অপেক্ষা করতাম সেটা হচ্ছে নারিকেলের নাড়ু। বাবা চাচারা নারিকেলের ছোবড়া ছাড়িয়ে নারিকেলের মালয়টাকে একেবারে টেকো মাথার মতো তেলতেলে পরিষ্কার করে ফেলতো।

jagonews24
শ্যালিকা পলির মায়ের হাতের বিভিন্ন রকমের নাড়ু

আমরা ছোবড়াটাকে মাথায় মুকুটের মতো পরে খেলাধুলা করতাম অনেকসময়। সেই তেলতেলে নারিকেলের মালয় ভেঙে পানিটা একটা গ্লাসে সংরক্ষণ করা হতো সেটা আমরা এমনি এমনিই খেতাম। এরপর শুরু হতো মায়েদের কাজ। নারিকেলের মালয় নারিকেল কোরার ওপরে ধরে নিপুণ দক্ষতায় ওপর নিচ করে নারিকেলের মালয় থেকে সবটুকু নারিকেল ছাড়িয়ে নিতেন। সেই কোরা নারিকেল দেখতে হতো অনেকটা সুজির মতো।

নারিকেল কোরার পাশাপাশি মাটির চুলায় একটা পাতিলে পানি জ্বাল দেওয়া হতো। পানি গরম হয়ে গেলে তার মধ্যে গুড়ের পাটালি ছেড়ে দেওয়া হতো। এরপর জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে গুড়ের পেস্ট তৈরি করা হতো। এরপর তার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হতো কোরা নারিকেল। তারপর জ্বাল দেওয়া চলতো যতক্ষণ না নারিকেলের এবং গুড়ের মিশ্রণটা হাতে নিয়ে দলা পাকানো যায়। একটু পর পর সামান্য পরিমাণ হাতে তুলে নিয়ে মায়েরা সেটা হাতের তালুইতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতেন যে সেটা দিয়ে গোলা তৈরি করা যাচ্ছে কি না। আমরা ছোটরা গোল হয়ে হাতের টুরিতে মুড়ি নিয়ে চুলার পাশে বসে অপেক্ষা করতাম কখন নাড়ু তৈরি হবে।

এভাবে চলতে চলতে একসময় নাড়ু তৈরি হয়ে যেতো। আমরা টুরির মুড়ির মধ্যে নিয়ে ঘুরেঘুরে সেটা খেয়ে বেড়াতাম। কারটা সবার পরে শেষ হবে সেটা নিয়ে মনে মনে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলতো কারণ তাহলে সে অন্যদের দেখিয়ে দেখিয়ে খেতে পারবে। নাড়ু পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে সেগুলো শুকিয়ে মুড়ির টিনের মধ্যে সংরক্ষণ করা হতো। পুরোনো দুধের টিনগুলো ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কিনে তারমধ্যে মুড়ি রেখে তার ভিতরে নাড়ু রাখা হতো। আমরা ছোটরা বিভিন্ন সময়ে চুরি করে সেগুলো খেয়ে ফেলতাম। মুড়ি আর নাড়ু ছিলো গ্রামদেশের বৈকালিক নাস্তা। বিশেষ করে ক্ষেতের কাজ সেরে পুরুষেরা বিকেলে বাড়ি ফিরলে তাদের একবাটি নাড়ু মুড়ির সাথে এক গ্লাস পানি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো।

jagonews24বোন শিল্পীর হাতের ক্ষুদ্র কিন্তু আন্তরিক আপ্যায়ন

এরপর নদী ভাঙনের কবলে পড়ে আমরা চরভবানীপুর থেকে কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদিতে চলে আসলাম সপরিবারে। এখানে এসে নারিকেল আর কেনা লাগতো না কারণ আমরা দু ভাই অন্যের গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমরা নির্দিষ্ট গাছতলায় যেয়ে হাজির হতাম। আমাদের সমবয়সী সব বাচ্চায় এই কাজটা করতো তাই এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের অলিখিত প্রতিযোগিতাও চলতো।

তবে আমরা দুভাই পিঠাপিঠি হওয়াতে অন্যরা আমাদের সাথে পেরে উঠতো না। আর আমরা দুভাই ভালো গাছে চড়তে পারতাম। অন্যের গাছ থেকে নারিকেল পেড়ে দিলে তারা তার বিনিময়ে নারিকেল দিতেন। এভাবেও নারিকেল জোগাড় হতো। এর বাইরে নাড়ুর আরো একটা যোগান ছিলো।

সেটা হলো আমাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। আমাদের এক বাড়ি পরেই ছিলো বলাই দাদু এবং কেশরী দাদুদের বাড়ি। উনাদের দুভাইয়ের বাড়ি পাশাপাশি। উনাদের ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী মিলে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে। বছরের সারা সময়টা জুড়েই উনাদের বাড়িদুটো গমগম করে মানুষের বিচরণে। পূজার সময় আরো বেশি মানুষের সমাগম হয়। দূর্গা পূজার পর আসে লক্ষ্মীপূজা। লক্ষীপূজার নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি সংগ্রহ করার চল ছিলো আমাদের মধ্যে। আমরা দুভাই এটা সংগ্রহ করতে যেতে লজ্জা পেতাম। তাই বলাই দাদু এবং কেশরী দাদুর স্ত্রী যাদের আমরা কর্তা বলতাম উনারা পালাক্রমে এসে আমাদের বাড়িতে নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি এগুলো দিয়ে যেতেন।

সারাবছর জুড়েই তাই আমরা দূর্গা পূজার চেয়ে লক্ষ্মী পূজার জন্য বেশি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম নাড়ু খাওয়ার জন্য। আমাদের মা’ও নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি বানাতেন কিন্তু উনাদের বানানো নাড়ুর স্বাদই ছিলো আলাদা। কর্তারা শাড়ির আঁচলের তলে লুকিয়ে সেগুলো এনে আস্তে করে মায়ের হাতে দিয়ে বলে যেতেন, আমার নাতিগুলোকে দিয়ো। এখনও লক্ষ্মী পূজার সময় আসলে তাই দুই কর্তার কথায় সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। দুই কর্তা আর বলাই দাদু মারা গিয়েছেন। এখন শুধু বেঁচে আছেন শুধু কেশরী দাদু।

দেশ ছাড়ার আগে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেশ ছেড়ে আসার পরও নিয়মিত যোগাযোগ আছে উনাদের সাথে। উনারা আসলে আমাদের পরিবারেরই অংশ। বড় কর্তার বড় ছেলে প্রদীপ কাকুর ছেলে বিদ্যুৎ আমার আশৈশব বন্ধু। মেয়ে শিল্পী আমাকে ভাই জ্ঞান করে। কুষ্টিয়া থেকে ফেরার আগেরদিন শিল্পীর বাসায় দাওয়াত করে মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে আমার পছন্দের লুচি-লাবড়া খাইয়েছিলো। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সামান্য আয়োজন কিন্তু আমার কাছে মনেহয়েছিলো আমার জীবনের সেরা খাবারটা খেলাম কারণ তাতে ছিলো বোনের আন্তরিক ভালোবাসার ছোঁয়া।

jagonews24
পুনম বৌদির দেওয়া বিভিন্ন রকমের নাড়ু

প্রবাসের এই গতিময় জীবনে এসেও নাড়ু আর বড়ার স্মৃতি তাড়া করে ফিরতো অবিরত। এখানে সব রকমের নারিকেলই পাওয়া যায় এমনকি কোরা নারিকেলের প্যাকেট পাওয়া যায় আর এশিয়ান দোকানগুলোতে পাওয়া যায় পাটালি কিন্তু বানানোর সঠিক প্রক্রিয়াটা জানা ছিলো না বলে আমরা একদিন নাড়ু বানালাম কিন্তু সেটা ততটা স্বাদের হলো না। এরপর রিনা ভাবীর মা দেশ থেকে আসার সময় সাথে করে নাড়ু নিয়ে এসেছিলো সেই নাড়ু আমার মায়ের হাতের নাড়ুর কথা মনে করিয়ে দিলো।

এরপর পঞ্জিকা ধরে একসময় লক্ষ্মী পূজা এসে হাজির হলো তখন পরিচিত বৌদিদের কে জ্বালাতন শুরু করলাম নাড়ুর জন্য। পুনম বৌদি ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মানুষ। এখানে আমাদের পাশের সাবার্বেই থাকেন। দূর্গা পূজায় যেয়ে উনার সাথে পরিচয় হলো। উনি আমার এই নাড়ু প্রীতির কথা জানতেন। তাই একদিন ফেসবুকে মেসেজ দিলেন, দাদা আপনার জন্য নাড়ু আলাদা করে রেখেছি কিন্তু দিতে পারছি না কারণ আমি ইদানিং ড্রাইভ করে অফিসে যায়। তাই আপনার সাথে আর স্টেশনে দেখা হচ্ছে না। তবে আমি ঠিক করেছি একদিন ট্রেনে করে যাবো সেদিন আপনার জন্য নাড়ু নিয়ে আসবো।

এরপর একদিন স্টেশনে ঢোকার মুখেই উনার সাথে দেখা হয়ে গেলো। সেই নাড়ু আমি, আমার অফিসের বিদেশি সহকর্মীরাসহ, শ্যালিকা মিশু ও মাহিন, আমার মেয়ে তাহিয়া আমরা সবাই মিলে অনেক মজা করে খেয়েছিলাম। এরপর শ্যালিকা পলি পালের মা দেশ থেকে বিভিন্ন রকমের নাড়ু নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো অনেকদিন ধরে খেয়েছিলাম। একবারে খাইনি কারণ তাহলে একেবারেই আনন্দটা ফুরিয়ে যেত। প্রতিবছর লক্ষ্মী পূজা আসলে তাই নারিকেলের নাড়ুর সাথে মুড়ি, মুড়কির কথা মনে পড়ে যায়।
প্রবাসের জীবন প্রচন্ড রকমের গতিময়।

এখানে আলাদাভাবে সুখ বা শান্তির অনুসন্ধান করারও সময় নেই। তাই আমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাগুলোর মধ্যে থেকেই আনন্দ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করি। সামান্য নারিকেলের নাড়ু আমাকে সেই সুযোগটা করে দিয়েছিলো। এই আনন্দের মুহূর্তগুলো অনেক ক্ষুদ্র হলেও তার প্রভাব মনের উপর থাকে অনেকদিন। ধন্যবাদ রিনা ভাবি, শ্যালিকা পলি এবং পুনম বৌদিকে আমাদের শৈশব কৈশোরের আনন্দনময় মুহূর্তগুলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

এমআরএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]