ভারত আমাদের কেমন বন্ধু

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:০৮ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০২৪
ছবি: সংগৃহীত

পথিক কাজী

‘৩৬ জুলাই! ২০২৪’ এরপর একটা বই পড়তে শুরু করেছি। বইটা এখনো বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, নাম ‘আমার ফাঁসী চাই’। লেখক মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমান রেন্টু বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, তাকে স্বস্ত্রীক বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তিনি ও তার স্ত্রী এই বইটি লেখার সংকল্প গ্রহণ করেন। হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি বইটা প্রকাশ করবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন।

পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কারো বিপদের সময় তাকে হেয় না করে, তার ক্ষমতার দাপটের সময়ই তিনি তার মুখোশ উন্মোচন করবেন। সেই মোতাবেক নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ও তার স্ত্রী বইটি লেখেন ও ১৯৯৯ সালে প্রকাশ করেন। স্বাভাবিকভাবেই বইটি তৎকালীন সরকারি আদেশে নিষিদ্ধ হয়। বইটি পড়া শেষ করে একটা রিভিউ লিখব আশা করি। তবে এই মুহূর্তে (যখন ভারতে শেখ হাসিনা লুকিয়ে আছেন এবং যুগপৎ বাংলাদেশের ও ভারতের পূর্বাঞ্চলে বন্যা চলছে) একটা অনুভূতি লিখে রাখতে চাই।

আমার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে যেহেতু বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের প্রতি প্রবল আনুগত্য দেখে, শুনে ও মেনে আমি বড় হয়েছি, তাই আমাকে যারা চেনেন, তারা এই লেখা পড়ে অবাক হতে পারেন। লেখার শিরোনাম, ‘ভারত আমার কেমন বন্ধু?’, এতে আমার পরিচিতজনেরা অবাক হতে পারেন। তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, এর আগেও (২০১২ সালে) ফেসবুকে আমি একটা কবিতা লিখে বেশ ভালো সাড়া পেয়েছিলাম, যার শুরুর ৩ লাইন ছিল এমন:

‘হে ভারতমাতা, তুমি মহান,
তুমি যখন তখন পানি ছেড়ে
ডুবাও মোদের প্রাণ...’

কবিতা পড়ার প্রহর এটা নয়। ফিরে আসি বর্তমানে। আমাদের বর্তমান নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার ভারত-বিদ্বেষী কি না তা বলার সময় এখনো আসেনি, তবে আওয়ামী সরকারের মতো ভারতের আজ্ঞাদাস যে নন, তা নিশ্চিত বলা যায়। প্রশ্ন হলো, ভারত আমাদের প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র। কিন্তু কেমন বন্ধু? আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা আমাদের প্রথমে আশ্রয়, তারপর প্রশিক্ষণ, তারপর অস্ত্র, তারপর সরাসরি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে সাহায্য করেছেন। এমন কি, মহান বিজয় দিবস-এ পাকবাহিনীর সেই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের ছবিতে আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে চুক্তি স্বাক্ষর করতে দেখি। তাহলে ভারত আমাদের খুব ভালো বন্ধু, তাই নয় কি?

‘আমার ফাঁসি চাই’ বইটিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখক বলতে চেয়েছেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলাদেশের সূচনা করতে গিয়েও করেননি। বরং তার দেওয়া আল্টিমেটাম পেয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দফায় দফায় সেনাবাহিনী পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে কঠোরভাবে দমনের প্রস্তুতি নেবার সুযোগ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু তার আল্টিমেটামে কোনো সময়সীমা বেঁধে না দেওয়ায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময় পেয়েছে এবং সেই রাতে অতর্কিতে গণহত্যা চালিয়েছে।

লেখকের মতে, সেই গণহত্যার পর স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে যদি ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার ডাক দিতেন, তাহলে এত রক্তপাত হতো না। গণমানুষের উপচেপড়া সে ময়দানে দেশের সবচেয়ে যিনি ভরসাস্থল, সেই নেতা বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং সেটা বলার পর কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারতো। কেন হয়নি?

আমার ধারণা, ভারত তখনও সায় দেয়নি তাই। ভারতের কাছ থেকে আশ্বাস না পেলে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটা আত্মঘাতী হতো, তাই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানকে অখণ্ড রেখেই পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অনুধাবন।

‘Inside RAW’ বইটা যদি কেউ পড়ে থাকেন, তিনিও আমার সঙ্গে একমত হবেন। এই বইয়ের একটি ছোট্ট অংশ থেকে একটি ঘটনা সরল ভাষায় বলার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হবার পর জিয়াউর রহমান যেবার প্রথম ভারত সফরে গেলেন, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাংলাদেশ কেমন চলছে? জবাবে জিয়া বলেছিলেন, ‘আমার দেশ কেমন চলছে সেটা আমার চেয়ে এই ভদ্রলোক বেশি জানেন।’

জিয়া ইংগিত করেছিলেন একই মিটিংয়ে উপস্থিত RAW এর প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও এর দিকে, যিনি বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের চেয়ে এ দেশের অভ্যন্তরীণ সকল খবরাখবর বেশি জানতেন।

স্কুল জীবনে একটা ভাব-সম্প্রসারণ আমাদের। পাঠ্য ছিল:

‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে
ভাই বলে ডাকো যদি, দেব গলা টিপে।
হেন কালে গগণেতে উঠিলেন চাঁদা,
কেরোসিন শিখা বলে, এসো মোর দাদা’

কাজেই পূর্ব পাকিস্তান তার পাশের দেশ ভারতকে ‘দাদা’ বলেই ডাকুক আর বন্ধু বলেই ডাকুক, দাদাটি কিন্তু দাদাগিরি করতে ভোলে না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন জাতির পিতা। দিনটি ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। কেন? জবাব সবার জানা। তিনি তো বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করতে তার বাসভবনে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে ছিল। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী সরকার ছাড়াও যারা বাংলাদেশের সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, তারা কি ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে? না। কারণ সেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক ছিল না।

কারণ, আকারে, মেধায়, ক্ষমতায়, সম্পদে এবং সম্পর্কে ভারত আমাদের সমকক্ষ নয়। ভারত কোনোকালেই আমাদের বন্ধু ছিল না, বরং ‘দাদা’ বা ‘দিদি’ ছিল এবং আছে। শুধু তাই না, আমাদের হেঁশেলে কোন হাড়িতে কী রান্না হচ্ছে বা হবে, সেটা নিয়েও তাদের টিকটিকিরা মাথা ঘামায় ও লেজ নাড়ায়।

৫ আগস্ট ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান ও হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতীয়, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার সংবাদ পরিবেশন ও টকশোগুলো দেখে আমার তো মনে হচ্ছিল ওরা একাত্তরে এসে এদেশ স্বাধীন করে দিয়েছিল এবং সেই থেকে এদেশের সব কিছুতে তাদের অধিকার জন্মে গেছে। এমন কি ৫ আগস্ট যখন এদেশের বিক্ষুব্ধ জনতা বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাংচুর করছিল, ভারতীয় মিডিয়ার আচরণে মনে হচ্ছিল ওদের কোনো দেবতার মূর্তি আমরা ভেঙে ঘোর পাপ করে নরকের নিকৃষ্ট অগ্নিগর্ভে দেশকে ঠেলে পাঠাচ্ছি।

কী গভীর হতাশা আর কী তীব্র ঘৃণা একটা দলের নেতার প্রতি তার দেশের জনগণের থাকতে পারে, তার গভীর কারণ ভারতীয় তথা পশ্চিম বাংলার তথাকথিত সাংবাদিকরা অনুধাবন করার চেষ্টাও করেনি। কেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বা বঙ্গবন্ধু গোটা বাংলাদেশের না হয়ে আওয়ামী লীগের কপিরাইট হয়ে গেলো- সেই ইতিহাস ওদের আজ কে বোঝাবে?

তাহলে কি সেই দাদা/দিদির কাছে আমরা নতজানু হয়ে থাকব? সেই জবাবটা দিয়েই ইতি টানব। তবে তার আগে কয়েকটি প্রশ্ন:

ভারত আমাদের চিরকাল তাদের অলিখিত উপনিবেশ করে রাখতে চেয়েছে। আমাদের যখন যা প্রয়োজন, তা দিয়েছে। বিনিময়ে কী না নিয়েছে?

আমরা চাল-ডাল-পেঁয়াজ -চিনি-পোশাক-বিনোদন-পর্যটন-চিকিৎসা কী না কিনি ভারত থেকে? এই সেদিনই ভারতীয় একটি টিভি চ্যানেলের টক শো-তে শুনছিলাম, বাংলাদেশ তাদের ১৫ বিলিয়ন ডলারের বাজার। এটাই তো আসল কথা। আমরা কিনি, তারা বিক্রি করেন।

ভারতীয় ভিসা পাওয়া এত কঠিন, তবু আমরা ভারতেই ছুটে যাই। কেন? আমাদের দেশের চিকিৎসা সেবার মান বা খরচ নিয়ে আমি আজ পর্যন্ত কোনো সরকারকে উদ্যোগী হতে দেখিনি। কেন? আমাদের সমাজের কয়েকটি শ্রেণির মানুষ বিয়ের বাজার করতে কলকাতা-দিল্লী-লখনৌ ছুটে যান। কেন? আমাদের দেশের কনসার্ট জমাতে আনতে হয় ভারতীয় তারকা।

কই, সেখানে তো ভারত-বিদ্বেষীরাও ভীড় করতে মিস করেন না! আপনি ভারতের খাবেন, ভারতের পরবেন, আর দিন শেষে ভারতকেই গালি দেবেন? তা ওরা মানবে কেন? এমন কি গোমতি নদীর বাঁধ কেউ খুলে দিলো, নাকি তা নিজেই খুলে গিয়ে ‘জল’ বের করে এদেশে বন্যা ঘটালো, তা ঠিকঠাক না জেনে ওদের মিডিয়াই বা কেন বললো, ‘ভারত ছাড়লো জল, বাংলাদেশ গেল তলিয়ে’? আর তা দেখে রাজশাহীর বাঘায় এক মাদরাসার ছাত্র কেনইবা একাই লোহার পাইপ নিয়ে গেলো মন্দিরের মূর্তি ভাঙতে! এত আবেগ কেন? আর তার এই স্থূল প্রয়োগ কেন? আজ দেশের অনেক বড় বড় কর্পোরেট-এর হর্তাকর্তা ভারতীয়। কেন? আমার দেশের মেধাবীরা ওদের কাছাকাছি বেতনে কি একই বা আরও ভালো পারফর্ম করতে পারত না? কেন এদেশে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই এত ভারতীয় উচ্চ পদে চাকরি করছে?

পরিশেষে বলব, আমরা যেদিন ওদের মুখাপেক্ষী না হয়ে সমানে সমান হয়ে দেখিয়ে দিতে পারব, সেদিন হয়তো ওরা আমাদের বন্ধু হবে।

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]