কবিগুরুর কাচারি বাড়িতে এক সন্ধ্যায়

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ১১:৫৪ এএম, ১৪ জুন ২০২৪
দেয়ালজুড়ে আছে কবিগুরুর হাতের লেখা এবং আঁকা ছবির প্রতিলিপি

কুষ্টিয়া জেলার সরকারি তথ্য বাতায়নে টেগোর লজ সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া যায়। ১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে ব্যবসার সাথে জড়িয়ে ফেলেন। তিনি ও তার দুই ভাগ্নে সুরেন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথের সহায়তায় শিলাইদহে টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি গড়ে তোলেন যৌথ মূলধনী ব্যবসা। সে বছরই ব্যবসায়িক সুবিধার্থে টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত করেন।

কোম্পানি দেখাশুনার জন্য কবি শহরের মিলপাড়ায় একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করেন। এখানে বসে কবি অসংখ্য কবিতা লেখেন যা পরবর্তীকালে ‘ক্ষণিকা’, কথা ও কাহিনীতে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে এ ভবনটিও একটি দর্শনীয় স্থান।

কবিগুরুর কাচারি বাড়িতে এক সন্ধ্যায়দোতলায় ওঠার লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি

কবিগুরুর মতো একজন মহান মানুষের স্মৃতিধন্য এই ভবনটি একেবারেই স্বল্প পরিচিত। কুষ্টিয়ায় কবিগুরুর স্মৃতি বলতে সবাই শিলাইদহ কুঠিবাড়ির উল্লেখ করেন। বিভিন্ন উপলক্ষে বনভোজন বা বেড়াতে সেখানে যান। সেই তুলনায় টেগোর লজকে তেমন কেউ চেনে না। কুষ্টিয়াতে জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠার কারণে নিজেকে সবসময়ই অনেক সৌভাগ্যবান মনে হয়। কতবার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। কিন্তু বাড়ির কাছের টেগোর লজে একদিনও যাওয়া হয়নি।

কবিগুরুর কাচারি বাড়িতে এক সন্ধ্যায়ভবনের পুরোনো আমলের চুন সুরকির ছাদ

অবশেষে সেই সুযোগটা এসে গেলো এ বছর মার্চ মাসে। জানুয়ারিতে আমাদের সাথে বেড়াতে আসা শ্বশুর শ্বাশুড়িকে দেশে রেখে আসতে যেয়ে দুটো দিন হাতে পেয়ে গেলাম। সেই সুযোগে কুষ্টিয়া চলে গেলাম। ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার বাসগুলো কল্যাণপুর থেকে ছাড়ে। আপনি অনলাইনেই টিকিট করে নিতে পারেন। কুষ্টিয়ায় বাসগুলো যায় দুইভাবে- পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে আর যমুনা সেতু দিয়ে। আমি যে বাসগুলো ফেরি হয়ে যায় সেটার টিকিট করে নিলাম। চার সাড়ে চার ঘণ্টায় আপনি কুষ্টিয়া মজমপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যাবেন।

কবিগুরুর কাচারি বাড়িতে এক সন্ধ্যায়টেগোর লজের প্রবেশপথ

কুষ্টিয়া শহরে বেশ ভালো মানের কিছু থাকার হোটেল আছে। আর কুষ্টিয়ার যেকোনো রেস্তোরাঁ থেকে আপনি দিনের যেকোনো সময়ের খাবার নিশ্চিন্তে খেয়ে নিতে পারেন। কুষ্টিয়া শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে রিকশা করে টেগোর লজে আসতে সময় লাগবে মাত্র কয়েক মিনিট। মূল রাস্তার পাশে সাদা দেয়ালঘেরা লাল রঙের দোতলা ভবন টেগোর লজ। রিকশা থেকে নেমে আপনি শুরুতেই দেয়ালের লেখাগুলো পড়ে নিতে পারেন। এরপর সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই হাতের বাম পাশে কবিগুরুর আবক্ষ ভাস্কর্য আপনাকে স্বাগত জানাবে।

কবিগুরুর কাচারি বাড়িতে এক সন্ধ্যায়টেগোর লজের পশ্চাৎভাগ

ওখান থেকেই আপনি ভবনের নিচতলার প্রবেশ দরজা দেখতে পারবেন। তার ওপরে ঝোলানো আছে কবিগুরুর একটি তেলচিত্র। এরপর ভেতরে প্রবেশ করলে আপনার মনে হবে আপনি যেন সময়ের ঘড়িতে চলে গেছেন একশ বছর পেছনে। ভবনের ঘরের মেঝে, ছাদ, দেয়াল, দরজা, জানালা, ঘুলঘুলি, বারান্দার রেলিং সবকিছুই আগের মতোই অক্ষত আছে। এগুলো আপনি হাত দিয়ে স্পর্শ করলে শরীরে এক ধরনের কম্পন অনুভব করবেন।

কবিগুরুর কাচারি বাড়িতে এক সন্ধ্যায়ঢুকতেই স্বাগত জানাবে কবিগুরু আবক্ষ ভাস্কর্য

কারণ একটা সময় এই জায়গায় ঠিক আপনার মতোই কবিগুরু চলাফেরা করতেন। দেয়ালগুলোতে কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্থিরচিত্র আছে। পাশাপাশি আছে কবিগুরু নিজস্ব হস্তাক্ষরের অনেক প্রতিলিপি।

এরপর পশ্চিম দিকের কামরার মধ্যে দিয়ে লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। এই ধরেনর সিঁড়ি এখন আর দেখা যায় না। আগেকার আমলে ডুপ্লেক্স বাড়ি মানেই এমন একটা সিঁড়ি থাকতো। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলে সামনেই একটা বড় কক্ষ পড়বে। সেখানেও কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্থিরচিত্র এবং লেখার প্রতিলিপি সংরক্ষণ করা আছে।

কবিগুরুর কাচারি বাড়িতে এক সন্ধ্যায়দোতলার বারান্দার লোহার রেলিং এবং সুদৃশ্য থাম

আপনাকে সময় নিয়ে ছবি এবং লেখাগুলো দেখতে হবে। এখানে বিভিন্ন সংগঠন তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকেন।আশপাশের কক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তখনকার সময়ের বেশকিছু আসবাবপত্র। একটা কামরায় আমি পুরোনো আমলের একটা টেবিল দেখতে পেলাম।

এই কক্ষগুলোর পরেই আছে টানা বারান্দা। বারান্দার সুদৃশ্য মোটা মোটা থামের ফাঁকে আছে লোহার রডের রেলিং। সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই এক হালকা বাতাস এসে গাঁয়ে লাগলো। আমি মনে মনে ভাবছিলাম কবিগুরুও নিশ্চয় গরমের দিনে এখানে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেন। ওখান থেকে নিচে চোখ পড়তেই নজরে এলো ভবনের ছোট আয়তাকার পেছনের খোলা জায়গাটা।

কবিগুরুর কাচারি বাড়িতে এক সন্ধ্যায়ভবনের পেছনে বসার বেদি

তার দুই কোণায় দুটো ঝাঁকড়া বকুল গাছ লাগানো। নিশ্চয় কবিগুরু বর্ষায় বকুলের সুবাস নিতেন। আর ঠিক মাঝ বরাবর বসার জন্য আছে এম্পিথিয়েটারের আদলের কংক্রিটের উঁচু বেদি। এরপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে সেখানে যেয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। আমার আগ্রহ দেখে তদারককারীদের একজন আলো জ্বেলে দিলেন।

এইভাবে প্রায় কয়েক ঘণ্টা সময় ওখানে পার করলাম। যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণই একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে ছিল। আর খারাপ লাগছিল এইভাবে যে এত কাছে কবিগুরু স্মৃতিধন্য এমন একটা সুন্দর স্থাপনা কেন এতদিনেও দেখতে আসিনি। আমি আরও বহুবার এই ভবনে যেতে চাই, স্পর্শ করতে চাই এই ভবনের সবকিছুই। টেগোর লজ নিয়ে প্রচার প্রচারণা বলতে তেমন কিছুই দেখিনি।

কবিগুরুর কাচারি বাড়িতে এক সন্ধ্যায়কবি গুরুর স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরো ভবনজুড়ে

কুষ্টিয়া জেলার তথ্য বাতায়ন ছাড়া আর তেমন কোনো প্রচার খুঁজে পাইনি। যাইহোক আমার মনে হয় কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে এই ভবনটার প্রচারের পাশাপাশি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবেন। জিনিসপত্রগুলো একটু গুছিয়ে নিয়মিত ঝাড়পোছ করে পরিষ্কার রাখলে আমার মনে হয় দর্শনার্থীর অভাব হবে না।

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]