মা দিবস

আম্মা কিছুই ভোলে না, আমার কোনো কিছুই মনে থাকে না

শায়লা জাবীন
শায়লা জাবীন শায়লা জাবীন
প্রকাশিত: ০৪:৩৫ পিএম, ১২ মে ২০২৪

আমার মা, নিঃসন্দেহে দেখতে বেশ সুন্দর, কেন জানি সুন্দরী শব্দটা ব্যবহার করতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। আমার কাছে মনে হয় সুন্দরী একটা বিশেষণ মাত্র যা অনেকেই হতে পারে, কিন্তু সবাই সুন্দর হতে পারে না, সুন্দর হতে গেলে সুশ্রী চেহারার পাশাপাশি কিছু অভ্যন্তরীণ গুণাবলী লাগে।

আমার আম্মার প্রথম ছবিটা যেই সময়ের তখনও তিনি ঠিক মা হয়ে ওঠেননি, তার বিয়ের কিছুদিন আগের ছবি, দ্বিতীয়টা বিয়ের পর..., এবং সবশেষের টা মা, শাশুড়ি, নানি, দাদি হয়ে যাওয়ার পর।

অনেকেই আমাকে আমার মার কার্বন কপি বলেন! সম্ভবত তারা আমার বাবাকে দেখেননি। অনেকেই বলেন আমি অনেকটাই মায়ের মতো কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি আমি দেখতে আমার মায়ের মতো না। না দেখতে, না স্বভাবে কোনো কিছুতেই আমার মা এর সাথে আমার খুব একটা মিল নেই। খুব চিন্তা করে বললে আমি আমার মায়ের কাছ থেকে গায়ের রঙ ছাড়া (সেটাও লেটার মার্কস ৮০%, ২০% ঘাটতি) তেমন কিছুই পাইনি। আমার আম্মার প্রায় ফটোগ্রাফিক মেমোরি সে কিছুই ভোলে না আর আমার প্রায় কিছুই মনে থাকে না।

jagonews24লেখিকার সাথে তার মা

আমার আম্মা এমন একজন মানুষ যিনি কোনোদিন কোনো বিষয়ে আমার সাথে একমত হয়নি, হতে পারেনি। আমি কিছু বলা মাত্র সে আমার ঘোর বিরোধিতা করেছে, এখনো করে। একটা সময় আমার দৃঢ় ধারণা হলো আমার যাবতীয় ভুল ধরার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং কিছু কঠোর বিধান দিয়ে আমার পুরো জীবন আটকে ফেলতে তিনি সদা সচেষ্ট। আমার কোনোকিছুই তার পছন্দ হয় না, কিছুই না, বই পড়া তো দু’চোখের বিষ, আমার ঘর সাজানো, কাপড় ভাঁজ করা, হাতের লেখা, সূচের কাজ, রান্না, লেখা লেখি, গান করা, নামাজ পড়া, গাছপালা পালা, শাড়ি কেনা ইত্যাদি কোনো কিছুই তার পছন্দ না।

এমনকি আমি চুপ করে থাকলেও তার অসহ্য, কেন কিছু বলছি না! আম্মার ভাষায় আমার মাথায় বুদ্ধি শুদ্ধি এত কম যে আমি কীভাবে চাকরি/ব্যবসা, সংসার, বাচ্চা সামাল দিয়ে এত গাছপালা পালি, রান্না করি, লিখি যে কিনা নিজের মাথার চুলের যত্ন নিতে পারে না এসব চিন্তায় তার প্রেসার যুগ যুগ ধরে লো!

আমার সেই মা যখন অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে আসলো তখন আমাকে দেখে, আমার কাজ কর্ম দেখে, ১২০কিমি/ঘণ্টায় গাড়ি চালানো দেখে, আমার রান্না খেয়ে, লেখা পড়ে, বাচ্চা পালা দেখে আমাকে বলেছে, তু্ই এগুলো কবে কখন শিখলি?! তু্ই তো সারাদিন গল্পের বই পড়তি, পরীক্ষার আগের দিন রাতেও!

বলেছিলাম, যখন সারাদিন আমার সঙ্গে বকা ঝকা করতে তখনই হয়তো, কিন্তু তুমি সারাক্ষণ চিৎকার করতে বলে বুঝতে পারোনি। তোমার চিৎকার চেঁচামেচির জ্বালায় আমি হয়তো আজ তেমন কিছুই হইনি কিন্তু আমার সন্তানেরা যেন হয় সেই দোয়া করো, কারণ আমি তোমার মতো সারাক্ষণ বকাঝকা করে তাদের জীবন ত্যনাত্যনা করে দেইনি। সারাজীবন দেখেছি মায়েরা মেয়েদের বন্ধু হয়, তুমি ছিলে আমার ঘরের শত্রু বিভীষণ।

আরও পড়ুন

আম্মা, এখনো আমার ছোটবেলা মনে পরলে আমি কখনই চাই না তোমার মতো মা কেউ তার জীবনে পাক! শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য সব দুর্বিসহ করে দিয়েছিলে আবার একথা শতভাগ সত্য যে আজকে আমি যতটুকু বা যতখানি সেই অবদানও সম্পূর্ণ তোমারই।

এত কড়া শাসনে বড় করেছো বলেই হয়তো এখনো নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে কষ্ট হয় না, এত আদেশ নিষেধ ছিল বলেই হয়তো এখন নিজেও আদেশ নিষেধে বড় হওয়া আর ছেড়ে দিয়ে বড় করা মানুষদের কথার পার্থক্য বুঝতে পারি। অনেক বেশি আচার-ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বলেই এখন যখন আচার-ব্যবহার বিহীন মানুষদের কথা শুনে কষ্ট পাই তখন নিজেকে সামাল দিতে পারি, তাদের মতো করে উত্তর দেই না।

অনেক বেশি নৈতিকতা শিখিয়েছো বলেই এখনো অনৈতিক মানুষদের ঘৃণা করি সর্বোপরি তোমার যন্ত্রণায় সারাক্ষণ বই পড়তাম বলেই যেকোনো চরিত্রের মানুষ দেখলেই তার অভ্যন্তর সহজে পড়ে ফেলতে পারি।

আম্মা, তোমার মতো বড় সমালোচক আমার কখনো কেউ ছিল না এখনো নাই, তোমার জন্যই এখনো যখন যেটাই করি যথাসম্ভব ঠিকমতো করার চেষ্টা করি এবং কোনো ভুল হলো কি না সেই ভয়ে নিজ জগতে নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকি কখনোই অন্যদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামাই না, ইচ্ছেও করে না, তাই কেউ ঘাটাতে এলেও প্রচন্ড বিরক্ত হই।

আমি সাধারণত আমার পরিবারের কারোর ছবিই পোস্ট করি না বা তাদের নিয়ে জনসম্মুখে লিখি না, নিজের ব্যক্তিগত জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের মানুষদের পর্দার আড়ালে রাখতেই পছন্দ করি। আজ নিয়মের ব্যতিক্রম করলাম। আমার মা বেশ অসুস্থ, বেশ কিছু শারীরিক সমস্যায় তিনি অনেক দিন ধরে ভুগছেন সাথে প্রেসার লো এবং এসব দেখতে দেখতে আমার প্রেসার হাই।

এখন আম্মার তিন ছেলেমেয়েই তার থেকে দূরে থাকে, আম্মার আগের মতো চিৎকার চেঁচামেচি করতে হয় না, এখন যতটুকু করেন অসুস্থ আব্বার সাথে! এছাড়া অখণ্ড অবসর। আম্মা, দোয়া করি তোমার আর আব্বার ব্যথাবিহীন, চিৎকার বিহীন স্বস্তির জীবনের, আল্লাহপাক তোমাদেরসহ পৃথিবীর সকল মা-বাবার নেক হায়াত বৃদ্ধি করুক।

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]