ছোটন ভাই

আপনি কি পিল খাওয়া নিয়ে ভাবছেন?

প্রদীপ মাহবুব
প্রদীপ মাহবুব প্রদীপ মাহবুব
প্রকাশিত: ০৪:০৪ পিএম, ১২ মে ২০২৪
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের বেড়ে ওঠা নানার বাড়িতে। সেই সূত্রে নানা বাড়ির লোকজনই আত্মার আত্মীয়। নানা বাড়ির প্রতিটি মানুষের জন্য কলিজার টান অনুভব করি। নানা বাড়ির মানুষজন মনে করেন কি না তা জানি না। আমরা চার ভাইবোন নানাকে দাদা বলে ডাকতাম। দাদা আমাদের এত আদর করতেন বিশেষ করে আমাকে যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমার জীবনে দাদার প্রভাব অনেক। দাদার গল্প অন্য একদিন করবো।

আমার নানা আর মামারা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় যুক্তি ছিলেন। তার মধ্যে ফিরোজ আর কাজল ভাইজান (সম্পর্কে নানা হলেও বয়সের জন্য আমরা ভাইজান ডাকি) ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৯০ সালের দিক থেকে তারা পাকুন্দিয়া বাজারে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। যতটুকু বুঝতাম কাজল ভাইজান খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। খুব সম্ভবত ১৯৯০ সালের দিকে ভাইজানেরা একটা টিভি কিনেছিলেন। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার আগে। টিভিটি কাজল ভাইজানের ঘরেই রাখা হয়েছিলো। টিভি রাখার জন্য একটা বিশেষ বাক্সের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। টিভির বাক্সে কেচিগেটের মতো দুটো ছোট দরজা ছিলো।

কাজল ভাইজান বাড়িতে এসে বাক্স খুলে টিভি চালাতেন। আর এলাকার মানুষসহ আমরা একসাথে টিভি দেখতাম। সতেরো ইঞ্চি সাদাকালো টিভি। টিভির নাম ছিল নিক্কন টিভি। কয়েকদিন আগে জানতে পারলাম ভাইজান টিভিটা বাইরে ফেলে রেখেছেন। কথাটি শুনে খুব খারাপ লাগলো। প্রায় ৩৫ বছরের একটা টিভি। কত স্মৃতি, কত মায়া! টিভির পেছনে কত যে সময় ব্যয় করেছি তার ইয়াত্তা নেই।

সেই সময়ে আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। টিভি চালানোর জন্য বারো ভোল্টের একটা ব্যাটারি ছিল। সেই ব্যাটারি চার্জ দিতে বেশ কিছুদিন সময় লাগতো। প্রতি সপ্তাহে রিকশা করে এই ব্যাটারি পাকুন্দিয়াতে আনা নেওয়া করা হত। একবার চার্জ দিয়ে আনলে ব্যাটারিটি দিয়ে এক সপ্তাহ টিভি দেখা যেতো। টিভি কী আর দেখতাম! এন্টেনা ঘুরাতে ঘুরাতে তিন ঘণ্টার ছবি শেষ হয়ে যেতো।

শুধু ঝিরঝির করতো। আর আমরা শুধু এন্টেনা ঘুরাতাম। যেদিন আবহাওয়া খারাপ থাকতো সেদিন টিভি দেখা খুব কষ্টকর হতো। সেইসঙ্গে যুক্ত হতো দিন দিন ব্যাটারির চার্জ কমে আসার যন্ত্রণা। ব্যাটারির চার্জ যেতে যেতে এমন অবস্থা হতো যে সতেরো ইঞ্চির টিভি ছয় ইঞ্চি হয়ে যেতো। তারপরেও যতোক্ষণ টিভিতে আলো আসতো ততোক্ষণ টিভি দেখতাম।

শনিবার, মঙ্গলবার আর শুক্রবার টিভি দেখার জন্য সেরা দিন ছিল। শনিবার রাতে ছায়াছন্দ প্রচারিত হতো। বাংলা সিনেমার গান দেখার সে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। মঙ্গলবার আর শুক্রবারে ধারাবাহিক নাটক, আরব্য রজনীর সিরিয়াল, আর মাঝে মধ্যে সিনেমা প্রচারিত হতো। সে সময়ে এক মাস অন্তর অন্তর বিটিভিতে সিনেমা প্রচারিত হতো। তবে মাঝে মধ্যে সিনেমা প্রচারিত হতো না। সেদিন সবার মন খারাপ হতো।

আগের পর্ব পড়ুন এখানে

যে শুক্রবার বিটিভিতে সিনেমা প্রচার করতো সেইদিন আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক মানুষ আসতো। একবার এই টিভি আউলিয়া পাড়ার সুন্দর মিস্ত্রির বাড়িতে নেওয়া হলো। ভাইজানদের ঘর বানিয়ে দেওয়ার সুবাদে এই মিস্ত্রির সঙ্গে তাদের একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। যেদিন রিকশায় করে টিভি আর ব্যাটারি সুন্দর মিস্ত্রির বাড়িতে নেওয়া হলো সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার এখনও মনে আছে, এই রিকশার পেছনে মৌমাছির মতো মানুষ ছুটতে লাগলো। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। সেদিন আউলিয়া পাড়ার অনেক মানুষ সুন্দর মিস্ত্রির বাড়িতে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন।

শুক্রবারে বিটিভিতে সিনেমা প্রচারিত হলে ভাইজান টিভিটা ঘরের দরজার কাছে এনে মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিতেন। উঠোন ভর্তি শুধু মানুষ আর মানুষ। বাড়ির মুরুব্বিরা সবাই চেয়ারে বসতেন। আমাদের সবসময় একটা বিশেষ কাঠের টুকরা দেওয়া হতো বসার জন্য। এর প্রকৃত নাম জানা নেই। তবে আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে বেন্দা বলে। এটা আসলে দরজায় ব্যবহৃত এক ধরনের খিল। গ্রামের সব দরজায় ছোট একটা খিল থাকতো। এর পাশাপাশি আর একটা লম্বা কাঠের গোড়া দরজার এ মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত ব্যবহার করা হতো।

মূলত চোর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই বেন্দার ব্যবহার ছিল। সেই বেন্দায় আমি, ভাই, ইকবাল আর ছোটন ভাই বসতাম। মাঝে মাঝে আরমান মামাও বসতেন। এই বেন্দা ব্যবহারের অন্যতম একটা কারণ ছিল মোটর সাইকেলকে রক্ষা করা। তখনকার সময়ে আশপাশের দুই চার গ্রামে এই একটাই মোটর সাইকেল ছিল। ইয়ামাহা (Yamaha) মোটর সাইকেল। কাজল ভাইজান খুব শখ করে মোটর সাইকেলটি কিনেছিলেন।

মোটর সাইকেলের শব্দ এক কিলোমিটার দূর থেকে পাওয়া যেতো। ভাইজান যদিও চাবি লুকিয়ে রাখতেন তারপরেও কীভাবে যেন আরমান মামা টিভি দেখানোর ব্যবস্থা করতেন। যেই দূর থেকে মোটর সাইকেলের শব্দ শোনা যেতো আমরা দৌড়ে পালাতাম। টিভি বাক্স বন্দি করে যে যার মতো পড়ার টেবিলে বসে পড়তাম।

টিভি কেনার বেশ কয়েক বছর পর বিটিভিতে প্রচারিত আলিফ লায়লা আমাদের পাগল করে তুলেছিলো। তখন সেই সিরিয়াল অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। শুক্রবারে সিরিয়াল প্রচারের সময় ছিল রাত সাড়ে আটটা। রাত আটটার সংবাদের পর আলিফ লায়লার জন্য আমরা চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতাম। সিরিয়ালের আগে শুধু বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন।

বিজ্ঞাপনগুলো অনেক মজার ছিল। ‘ও ফরিদ ভাই, তোমার দোকানে কী খাবার স্যালাইন আছে?’ নামের একটা জনপ্রিয় খাবার স্যালাইলেনর বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো। প্রচারিত হতো বউ রাণী প্রিন্ট শাড়ি এবং ফিলিপস বাতির জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন। সিরিয়াল শুরুর আগে ইকোনো কলমের একটা বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো। বিজ্ঞাপনটি মূলত কার্টুন ধরনের। এই বিজ্ঞাপন দেওয়ার মানেই হচ্ছে বিটিতে এখন একজন আলিফ লায়লার ঘোষণা দেবেন।

ঠিক এই বিজ্ঞাপনটি প্রচারের আগে কয়েকটা জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী বড়ির বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো। মাঝে মাঝে কনডমের বিজ্ঞাপনও দেখাতো। সে সময়ে এমন অ্যাডাল্ট কনন্টের বিজ্ঞাপন আমরা খুব একটা না বুঝলেও ছোটন ভাই বুঝতো। এসব বিজ্ঞাপন প্রচার হলে বাড়ির নারীরা একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতেন। জন্ম নিরোধক বড়ির বিজ্ঞাপনের মধ্যে মায়া বড়ি (Maya Bori) আর নরডেট ২৮ (Nordette 28) বিজ্ঞাপন দুটি খুব ঘন ঘন প্রচারিত হতো। এর মধ্যে নরডেট ২৮ বিজ্ঞাপনের শুরুতেই একজন নারী বলতেন, আপনি কী পিল খাওয়া নিয়ে ভাবছেন?

আমরা সবসময়ই বিজ্ঞাপনটি দেখি। কেউ কখনও কোনও কথা বলেনি। একদিন আলিফ লায়লা শুরুর আগে বিজ্ঞাপনটি প্রচারের শুরুতেই একজন নারী যখন বললেন, আপনি কী পিল খাওয়া নিয়ে ভাবছেন? সঙ্গে সঙ্গে ছোটন ভাই উত্তর দিলো, ‘না, আমি পিল খাওয়া নিয়ে ভাবছি না।’

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]