চলন্তিকা

শায়লা জাবীন
শায়লা জাবীন শায়লা জাবীন
প্রকাশিত: ০৬:৪৩ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২৩

ঈশান ঈপ্সিতা বলে উঠলো..., ফারিন আন্টি, কেমন আছো?
:সোনাপাখি জান বাচ্চা দুইটা আমার, ভালো আছি, কত্তদিন পর দেখলাম তোমাদের, ফারিন জড়িয়ে ধরলো দুজনকেই, চোখে পানি
:কাঁদছো কেন? ইমাদ আসেনি? ঈপ্সিতা বললো

:খুশিতে কান্না করছি, তোমরা যখন ছোট্ট ছোট্ট ছিলে তখন সারাক্ষণ কোলে নিয়ে বসে থাকতাম, সেই বাচ্চারা আজ আমার চেয়ে লম্বা হয়ে গেছে, মাশা আল্লাহ। চোখ মুছতে মুছতে ফারিন বললো ইমাদ ওর বাবার কাছে আছে, কাল স্কুল খোলা তো, হোমওয়ার্ক বাকি, তাই আর আসেনি, বাদ দাও তো... তোমরা কেমন আছো বলো?

:সে কি রে, আমি তো ভেবেছিলাম তোদের আজ থেকে যেতে বলবো, তিন বছর পর দেখা, সামির, ইমাদ কেউ আসেনি! আমি তো ফোনে সামিরের সাথেও কথা বললাম, ফাহমিদা বললো..

:আপু আমি কি তাহলে এসে এমনি এমনি চেঁচামেচি করলাম? ছোটলোকের বংশ, বলে আপু ফোন দিয়ে যেতে বলেছেন, বাবা বা মা কেউ তো বলেননি, ঐটা তো ওঁনাদের বাড়ী, আপু তো মেহমান, দুলাভাইও তো একটা ফোন দিলো না। চিন্তা করো কেমন হীনমন্যতায় ভোগে, দশ বছর হলো বিয়ে হয়েছে, এখনো নাকি তাকে তার গুষ্টি শুদ্ধ দাওয়াত করে বলতে হবে। ওদিকে তার মা আরো এক কাঠি, বলে তোমার বোন এসেছে, কই একটা ফোন ও তো দিলো না, বললাম মাত্র তো এলো লম্বা জার্নি করে, ফোন দেবে।

বলে দেখা করতে যাবা যাও, বিকেলের নাস্তা, রাতের খাবার রেডি করে রেখে যেও, আর তাড়াতাড়ি আসো, কাল তানি আসবে...বুঝলি আপা, সারাক্ষণ তার নিজের মেয়েকে কি খাওয়াবে সেই চিন্তা, আর আমি চারটে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে দিন রাত ফাইফরমাস খাঁটি আর গামলা গামলা রান্না করে এদের খাওয়াই, আসার সময় সামির ইমাদকেও আসতে দিলো না, ইমাদ আসার জন্য ছটফট করছিলো, সামির ধমক দিয়ে পড়তে বসালো, বললো ওরা অনেক দিন আছে, পরে যেও, পুরো রাস্তা আমি কান্না করতে করতে এসেছি...
ঈশান বললো, আশ্চর্য, এমন কেন? তুমি জব শুরু করো আন্টি...

:করতে দেয় না রে বাবা, মেয়েদের নাকি ইনকাম করতে নাই, মেয়েরা রান্না করবে আর বাচ্চা পালবে।
:আম্মা এভাবে কি সংসার করা যায়? এটা কি তোমাদের যুগ যে যা বলবে তাই। ফাহমিদা বললো তোমরা সামিরকে কিছু বলো না কেন? একটা শিক্ষিত মেয়ে এতকিছু কেন মেনে নেবে? আব্বার সাথে কথা বলতে হবে, সানোয়ার আসুক
:হুম, মা তো ঠিকি বলেছে, তুমি আমাদের সাথে চলো আন্টি, ঈপ্সিতা বললো
:ইমাদকে রেখে আমি কোথাও যাবো না মা, যেতে পারবো না।

আব্বাকে বলে কোনো লাভ নেই আপু, বলবে কি করবা, সব ভাগ্য, আমার জন্য নাকি সারাক্ষণ দোয়া করে, কান্নাকাটি করে, একদিন নাকি সব ঠিক হবে! কচু হবে...
:আম্মা কিছু বলবা, ফয়সাল ও খুবই বিরক্ত সামিরকে নিয়ে, অনেকবার বলছে অস্ট্রেলিয়া যেতে, সে যাবে না। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার যে অবস্থা তাতে বাচ্চাদের কোনো ভবিষৎ আছে এদেশে?

কোহিনুর বেগম এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, বললেন, আমি কি বলবো... আমার মেয়ে কি আমার কাছে বেশি? কখনোই না, ওকে তো বলেছিলাম চলে আয়, আমার এখানে থেকে চাকরি কর, ইমাদকে ভর্তি করে দে, তোর বাবা ইতস্তত করে, বলে আত্মীয় পরিজন কি বলবে! ওদিকে সামিরও তো ইমাদকে দেবে না। প্রচন্ড ঘাড় ত্যাঁড়া ছেলে। ফারিন কীভাবে এত ছোট ছেলে ফেলে থাকবে? আমি নিজে মা, বুঝি তো। ফিরোজ তো বলে ডিভোর্স দিয়ে দিতে...

কলিং বেল বেজে উঠলো...
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাহমিদা এগিয়ে গেলো
সানোয়ার ফিরলো সালমানকে নিয়ে,এত ট্রাফিক জ্যাম, ঢাকাবাসী থাকে কীভাবে? আমি একদম ক্লান্ত হয়ে গেছি, আর জানুয়ারি মাসেও এত গরম,

আরে ফারিন যে! কখন এলে, কেমন আছো? সামির, ইমাদ কই?
জি দুলাভাই, ভালো আলহামদুলিল্লাহ, আপনি দেখি বুড়িয়ে গেছেন।
হ্যাঁ, আর বলো না, তোমার আপু খেতেই দেয় না, না খেয়ে খেয়ে বুড়িয়ে গেলাম এজন্য এইবার তোমার আপুকে নিয়ে বাজারে যাই নাই ,গতবারেই এক দোকানদার আমাকে বলছে আংকেল আর ফাহমিকে আপা! চিন্তা করো...বলেই হা হা হা করে হেসে উঠলো সানোয়ার

:আপু এখনো আগের মতোই, অনেক সুন্দরই আছে মাশাআল্লাহ, আপনি বুড়া বুড়া হয়েছেন। কেমন আছো সালমান ভাই?
:হ্যাঁ ভালো, তুমি?
আস সালামু আলাইকুম খালাম্মা, ভালো আছেন?
সালমান বললো, কোহিনুর বেগমকে দেখে এরপর হাতের ইশারায় ডাকলো ঈশান ঈপ্সিতাকে
ওরা ফারিনের কাছ থেকে উঠে গেলো সালমানের কাছে..
:আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি বাবা, তোমার আব্বা আম্মা কেমন আছেন?
জি, ভালো আছেন, ভাইয়া ভাবি বাচ্চাদের জন্য অপেক্ষা করছেন, আমিও যাবো ভাবছি, যুথির ছুটি ম্যানেজ হলেই, অনেকদিন যাই না, আর সবাই একসাথে গেলে অনেক মজা হবে।
হ্যা বাবা, যেও...

তোমরা কথা বলো আমি আসরের নামাজটা পড়ে আসি, বেশি সময় নেই।
সানোয়ারকে নিয়ে ফাহমিদা ও ঘরে গেলো,
:কি ব্যাপার, মাত্র তিন বছরে তোমরা এত লম্বা হয়ে গেলে কি করে? কই আমি তো আর লম্বা হইনি একটুও!
:চাচ্চু, কি যে বলো, তিন বছর কম হলো? ১০৯৫ দিন, তাছাড়া তোমার বুঝি আর লম্বা হওয়ার বয়স আছে? আমি কিন্তু এখন তোমার চেয়েও লম্বা

:হুম, তোমরা কেমন আছো? ঢাকা কেমন লাগছে...
:ভালো কিন্তু অনেক গরম, আমরা রাজশাহী গেলে কিন্তু মাছ ধরবো চাচ্চু , ফিশিং রড দিয়ে, নেট দিয়েও ঈশান বললো
আমাকে কোকোনাট গাছের পাতা দিয়ে রিস্ট ওয়াচ বানানো শেখাবে? লাস্ট টাইম লাইলী দেখিয়েছিলো, ভুলে গেছি। ঈপ্সিতা বললো
সানোয়ার ফারিনকে দেখছিলো, হেসে বললো আচ্ছা মাছ ধরা হবে,সব হবে..., ফারিন সামির আসেনি?

ফারিন চোখাচোখি হতেই মাথা ঝাকিয়ে না বলে হেসে এড়িয়ে গেলো, বললো তোমরা গল্প করো আমি বুয়া কি করে দেখে আসি বলে রান্নাঘরের দিকে গেলো
:সালাম ভাবি কেমন আছেন?
ফাহমিদা এলো, আসর নামাজ পড়ে এলাম, সময় ছিলো না, তোমার ভাই পড়ছে এখন। এই তো আছি আলহামদুলিল্লাহ, তুমি ও তোমরা কেমন? যুথি, ইমিরা?

:আমরা আছি, দৌড়ের ওপর... এত ব্যস্ততা, তার ওপর ইমিরা এখন স্কুলে যায়, যুথির জব, সবমিলিয়ে পাঁচদিন আমরাও ভীষণ ব্যস্ত থাকি। খালাম্মা খালুজানকেও নিয়ে চলেন রাজশাহী, ওঁনাদের ভালো লাগবে, আব্বা আম্মাও খুশি হবে। আমি ছুটি নিয়েছি, যুথিও বলেছে ওর ম্যানেজার কে, আজ জানতে পারবো।
:দেখি, বলে দেখবো... আব্বা আম্মা কোথাও যেতে চায় না।
একরাম হোসেন গলা খাকারি দিয়ে ডাইনিং এ আসলেন..
সালমান সালাম দিলো, সানোয়ারও এলো...

ওয়ালাইকুম সালাম, তোমরা বসো সবাই, দাঁড়িয়ে কেন? বেয়াই বিয়াইন কেমন আছেন?
বসতে বসতে সালমান বললো, জি খালুজান ওঁনারা ভালো, আপনারা চলেন আমাদের সাথে রাজশাহী, ভাইয়া ওঁনাদের নিয়ে আসো, ভাবিকেও বলেছিলাম

:আমার সালাম দিও ওঁনাদের, এইবার না, পরে একসময় যাবো, ফিরোজ আসতে চেয়েছে, দেখি আসে কিনা
টেবিলে মোগলাই পরাটা, শসা কুচি আর সাজানো চটপটি রেখে গেলো ফারিন আর বুয়া, এরপর আনলো ছানার সন্দেশ আর কমলা
সবাই বস নাস্তা করে চা খাও, সালমান রাতের খাবার খেয়ে যেও।
:না খালাম্মা, আজকে চা খেয়ে উঠতে হবে, আর একদিন। ওদিকে কিছু কাজ আছে, যুথি অপেক্ষা করবে...
সবাই খাচ্ছে, ফারিন বললো কাল তোমাদের প্ল্যান কি আপু দুলাভাই?
আমার বাসায় আসো

না রে, রাজশাহী থেকে ঘুরে আসি আগে, কাল আমি আমার কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করবো, সানোয়ার বললো, ফাহমিদা বললো আমিও আমার কিছু ফ্রেন্ডদের দেখা করবো, বহু বছর দেখা হয় না।
এই সময় একটা মোবাইল বেজে উঠলো...
কোহিনুর বেগম ধরলেন, হ্যালো হ্যা ফিরোজ, কেমন আছিস? কবে আসবি? কি বল্লি...ওহ, সেটা তো আমি জানিনা, তোর বাবা জানে...

হ্যাঁ, আছে, দিচ্ছি
এই যে ফিরোজ, তোমাকে চায়....
একরাম হোসেন ফোন ধরলেন, হ্যাঁ কেমন আছো তোমরা?
কিছু একটা শুনে চুপ থাকলেন কিছুক্ষণ, এরপর একটু থেমে বললেন, এসব নিয়ে কোন কথা হয়নি... একরাম হোসেন আবারো চুপ, এরপর বললেন তুমি আসো আগে, তারপর প্রয়োজন হলে দেখা যাবে, এখন রাখছি, তোমার মা'র সাথে কথা বলো, বলে ফোনটা কোহিনুর বেগমের দিকে এগিয়ে দিলেন
কোহিনুর বেগম হ্যালো বলতে যেয়ে দেখলো লাইন কাটা
ফাহমিদা জিজ্ঞাসা করলো, ফিরোজ কি বললো আব্বা, আসবে?
জানতে চাইলো, এইবার সম্পত্তি ভাগাভাগি হবে কিনা, তাহলে আসবে।
(ঈশান আর ঈপ্সিতা ছাড়া সবাই থমকে যেয়ে একরাম হোসেন এর দিকে তাকালেন)
ফাহমিদা বললো, তুমি কি বললে...
:সব কথার জবাব সবসময় মুখে দিতে হয় না, কিছু কিছু কথার উত্তর সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হয়।
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।

চলবে...

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]