শপথ নিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম
মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তিনি দেশটির প্রধান রাজা ও পেনাংয়ের সুলতান আবদুল্লাহ রিয়াতউদ্দিন আল মোস্তাফার উপস্থিতিতে শপথ নেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ নভেম্বর) মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম দ্য স্টার ডট কমের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কুয়ালালামপুরে সুলতান আবদুল্লাহর প্রশাসনিক ভবন আসতানা নেগারা প্রাসাদে স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায় শপথ নেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
৭৩ বছর বয়সী মালয়েশিয়ান এ নেতা ছাত্রনেতা থেকে সংস্থারপন্থি অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রী থেকে উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়া, বারবার কারাবরণ এবং মালয়েশিয়ার কয়েক দশকের শাসনকারী দলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের প্রতিটি পর্যায়ের নায়ক।
২৬ বছরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন ও ২০ বছরের জেলখাটা মালয়েশিয়ানের নানা ষড়যন্ত্র তার স্বপ্নপূরণে অলঙ্ঘনীয় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আনোয়ার বলেছিলেন, ‘আপনি যদি অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর হন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হন, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর হন, সম্পদের পাহাড়গড়া কিছু পরিবারের বিরুদ্ধে কঠোর হন তাহলে শাসকগোষ্ঠীর কাছে তো জনপ্রিয় হতে পারবেন না। এ সম্পর্কে আমি পূর্ণ ওয়াকিবহাল।’
আনোয়ার ইব্রাহিম ১৯৪৭ সালে মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পেনাং রাজ্যের চিরোক তক্কুন গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইব্রাহীম আব্দুল রহমান একজন হাসপাতালের কর্মচারী ছিলেন এবং পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তার মা চে ইয়েন হুসেন একজন গৃহিণী ছিলেন।
আনোয়ার ইব্রাহিম তার শিক্ষাজীবন তার নিজ গ্রামে শুরু করেন। তিনি মালয় কলেজ কুয়ালা কানজার থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে মালয় স্টাডিজ এ অনার্স এবং ১৯৭৪-৭৫ সালে জেলে থাকা অবস্থায় মাস্টার্স সমাপ্ত করেন।
তিনি তার ছাত্রজীবনে ১৯৬৮-১৯৭১ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মালয়েশিয়ান মুসলিম স্টুডেন্টসের সভাপতি ছিলেন। একই সময়ে তিনি ইউনিভার্সিটি অব মালয়া মালয় ল্যাংগুয়েজ সোসাইটির সভাপতি ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুসলিম ইয়ুথ মুভমেন্ট অব মালয়েশিয়া সংগঠিত হলে এর সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা ও প্রো কমিটির সদস্য ছিলেন এবং একই বছর তিনি মালয়েশিয়ান ইয়ুথ কাউন্সিলের দ্বিতীয় সভাপতি নির্বাচিত হন।
আনোয়ার একজন ইসলামপন্থি নেতা হওয়ার পরেও ১৯৮২ সালে প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের উদারপন্থি দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অরগনাইজেশন এ যোগ দেন এবং সাংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী, ১৯৮৪ সালে কৃষিমন্ত্রী এবং ১৯৮৬ সালে শিক্ষামন্ত্রী হন। শিক্ষামন্ত্রীর পদ তার মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ উপ-প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দ্বার খুলে দেয়।
শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর আনোয়ার ‘ন্যাশনাল স্কুল কারিকুলাম’ প্রণয়ন করেন। মালয়েশিয়ার জাতীয় ভাষার নাম ‘বাহাসা মালয়েশিয়া’ থেকে বাহাসা মেলায়ু এ পরিবর্তন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান এবং ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তাতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮৯ সালে ইউনেস্কো সাধারণ অধিবেশনের ২৫তম সভাপতি নির্বাচিত হন।
প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ আনোয়ারকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করলে, আনোয়ার ও তার সমর্থকরা ‘সংস্কার আন্দোলন রিফর্মাসী মুভমেন্ট’ শুরু করেন। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বারিসন ন্যাশনাল সরকারের নীতি বহির্ভূত কর্মকাণ্ড বিলোপ করা। ১৯৯৮ সালে কুয়ালালামপুরে অ্যাপেক সম্মেলনে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও অন্যান্য এ্যাপেক প্রতিনিধিদের সামনে আনোয়ার ও তার সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে ভাষণ দেন।
২০১৮ সালের ৯ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান জোট ২২২ আসনের পার্লামেন্টে ১১২ আসনে বিজয়ী হয়। এর মধ্যে আনোয়ারের পিকেআর পায় ৪৮ আসন।
তুখোড় এ মালয় নেতা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে সামলে ২৮ বছর আগে ১৯৯৩ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রী হন। মনে করা হচ্ছিল প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন তিনি। ১৯৯৭ সালে এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট শুরু হলে মাহাথিরের সঙ্গে আনোয়ারের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তিনি সরকারের অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির সমালোচনা করতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে বিরোধের সূত্র ধরে তিনি বরখাস্ত হন। এরপর শুরু হয় তার দুর্ভাগ্যের সময়। তার বিরুদ্ধে সডোমিসহ নানা অভিযোগ আনেন মাহাথির। জেলে কাটাতে হয় তাকে বছরের পর বছর। মাহাথির দুই দশকের বেশি সময় দেশ শাসন করে অবসর নিলে নতুন একাধিক প্রধানমন্ত্রীও আনোয়ারের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখেন। এই দলের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও তার স্ত্রী ব্যাপক দুর্নীতি করলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির দেশের অর্থনীতি রক্ষায় আবার নতুন দল করে রাজনীতিতে ফেরেন। তিনি সঙ্গে নেন সাবেক সহযোদ্ধা আনোয়ারকে। মাহাথির অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চান, অতীতের গ্লানি ভুলে আনোয়ারও সম্মতও হন মাহাথিরের প্রস্তাবে।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মাহাথির ও আনোয়ারের রাজনৈতিক জোট দেশটির সাত দশকের ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করে জয় পায়। তাদের পাকাতান হারাপান জোট বিজয়ী হয় ২২২ আসনের পার্লামেন্টে ১১৩টিতে। মাহাথিরের নতুন দল ছিল ছোট, তারা আসন কম পায়, মাত্র ১৩টি। আনোয়ারের দল পায় বেশি আসন, ৪৭টি। তবু তিনি মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ দেন। শর্ত থাকে, দুই বছর পর আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী হবেন।
২০২০ সালে মাহাথির পূর্ব সমঝোতা অনুসারে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি করতে থাকেন। এ সময় মাহাথিরের দলের নেতারা দাবি করেন, মাহাথিরকে পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে দিতে হবে। এ নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতাসীন জোটে ভাঙন দেখা যায়। এর জেরে মাহাথির পদত্যাগ করেন। এরপর রাজা মাহাথিরের আপত্তি উপেক্ষা করে মুহিউদ্দীন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। সংসদে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল কি না তা নিয়ে ঘোর সংশয় ছিল। এ কারণে সংসদে ভোটাভুটির আয়োজন করার সাহস দেখাতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দীন। শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেন তিনি।
এসব প্রশ্নের মধ্যেই এখন জানা যাচ্ছে, মাহাথির স্থিরচিত্ত ছিলেন যাতে আনোয়ার ইব্রাহিম দেশের প্রধানমন্ত্রী না হন। তবে এবার আর শেষ রক্ষা হলো কই?
গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত ভোটারদের শান্তিপূর্ণ ভোটদানে দেশটির ২ কোটি ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩৮ নিবন্ধিত ভোটার ও মোট ২২২টি আসনের মধ্যে মাইউন্ডি ডট কম ডট মাই সরকারি পোর্টালের তথ্য মতে, তুখোড় এ নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের জোট পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জয় পেয়েছেন ৮২টি আসনে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পেরিকাতান ন্যাশনাল (পিএন) জোট জয় পেয়ছেন ৭৩টি আসনে। দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে সাজাপ্রাপ্ত সাবেক নেতা নাজিব রাজ্জাকের দল বারিশান ন্যাশনাল (বিএন) জয় পেয়ছেন মাত্র ৩০টি আসনে। তাছাড়া বর্ণেও মালয়েশিয়ার সারোয়াক রাজ্যের জিপিএস পেয়েছেন ২২টি আসন ও জিপিআরএস পেয়েছেন ৬টি আসন এবং সাবাহ রাজ্যের ওয়ারিশান পেয়েছেন ৩টি আসন ও অন্যরা পেয়েছেন ৩টি আসন। যা এককভাবে সরকার গঠনে কোনো দলের সামর্থ্য ছিলোনা।
ফলে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ আনোয়ার ইব্রাহিমই মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিলেন।
এমএএইচ/জিকেএস