গ্রিসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, বিপাকে বাংলাদেশিরা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি সংকটে দিন পার করছে ইউরোপের দেশগুলো। গ্রিসে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপাকে পড়েছেন প্রবাসীরা। দিন দিন বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। যার প্রভাবে আয়ের তুলনায় প্রয়োজন পূরণে হিমশিম খাচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। যারা পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন তাদের অবস্থাও নাজেহাল।
সম্প্রতি জেনারেল কনফেডারেশন অফ গ্রিক ওয়ার্কার্সের শ্রম ইনস্টিটিউটের (আইএনই/জিএসইই) নতুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন বুলেটিনে, ‘হেলাসে জীবনযাত্রার সংকট’ শিরোনামের এক গ্রিসে শ্রমিকদের ক্রয় ক্ষমতা ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জ্বালানি এবং পণ্যের দামের তীব্র বৃদ্ধি কর্মীদের ক্রয়ক্ষমতা এবং তাদের জীবনযাত্রার মানকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রধানত জ্বালানি ও খাদ্যের মতো মৌলিক জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে এমন পরিস্থির মুখোমুখি তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাদের মাসিক আয় ৭৫০ ইউরোর কম, তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে ৪০ শতাংশ। এছাড়াও, প্রতি মাসে ১১০০ ইউরো গড় আয়ের পরিবারের ক্রয়-ক্ষমতা কমেছে ৯ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে। সর্বোচ্চ আয়ের বন্ধনীতে ক্রয়-ক্ষমতার ক্ষতি ১১ শতাংশের চেয়ে কম এবং আয়ের স্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায়। ব্যতিক্রম হলো ৩৫০০ ইউরোর ওপরে মাসিক আয়, যার ক্রয় ক্ষমতার ক্ষতি এমনকি পূর্ববর্তী স্কেলের (২৮০১-৩৫০০ ইউরো) ক্রয় ক্ষমতার ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে, যেহেতু উচ্চ স্কেলে খরচ আগেরটির তুলনায় অনেক বেশি।
ইউরোপের এই দেশটিতে বসবাস করেন প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি। এদের মধ্যে সিংহভাগই অনিয়মিত। করোনা মহামারির ধাক্কা সামাল দেওয়ার পর এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের বাজারের বেসামাল পরিস্থিতি। প্রতিনিয়তই বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নিম্ন আয়ের ও কর্মহীন মানুষের। বৈধভাবে চলাচলের কাগজপত্র না থাকায় অনেকেই পুলিশি হয়রানির কারণে কাজ করতে পারেন না।
ফলে বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীরাই বেশি বিপাকে পড়েছেন। বাংলাদেশ থেকে নৌপথে রপ্তানি করা পণ্যের দামও বেড়েছে। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে যে কন্টেইনার খরচ হতো ২ থেকে ৩ হাজার ইউরো তা এখনো তিন থেকে চারগুন বেড়েছে।
জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছিল মূলত করোনাভাইরাস মহামারির সময়। তখন থেকেই জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও এবার চলতি বছর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তেল-গ্যাসসহ সকল পণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগেছে।
ব্যবসায়ী রুবেল আহমদ বলেন, যারা স্বপরিবারে থাকেন তাদের অবস্থাও ভালো নেই। বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল আর বাজার খরচ মিলিয়ে এখন ছোটখাটো ব্যবসা বা চাকরি করে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ দুর্বিষহ ব্যাপার। বাচ্চাদের পড়া লেখার খরচসহ সব কিছুই ঊর্ধ্বগতি।
বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রিসের সহ-সভাপতি শাহনূর রিপন বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ভোজ্যতেল থেকে পশুখাদ্যসহ সবকিছুর দামই বাড়ছে। যারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আছেন তারা হয়তো এতটা খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েননি। কিন্তু যারা নিম্ন আয়ের বা কর্মহীন তারা পড়েছেন বেকায়দায়।
গ্রিসে বেশিরভাগই অনিয়মিত। নতুন যারা এসেছেন তাদের অনেকেরই কাগজপত্র নেই, তারা শহরে কোন কাজও করতে পারে না। বিশেষ করে যারা পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন তারাও এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছে। বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও বেচাকেনা কমে গেছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, যে চালের বস্তার মূল্য ছিল ৪৫ ইউরো তা বর্তমানে ৫৫ ইউরো, গ্যাস ছিল ১৫ ইউরো তা এখন ১৯ থেকে ২০ ইউরো। ৫ লিটার তেলের মূল্য ছিল ৭ ইউরো এখন ১১ থেকে ১২ ইউরো।
এদিকে জেনারেল কনফেডারেশন অফ গ্রিক ওয়ার্কার্সের শ্রম ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, স্বল্প আয়ের ওপর উচ্চ ব্যয়ের অসম প্রভাবের কারণে আংশিকভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ক্রয় ক্ষমতা হ্রাসের একটি অতিরিক্ত নেতিবাচক প্রভাব ভোগ এবং বৃদ্ধির গতিশীলতাকে উদ্বিগ্ন করেছে।
একই সময়ে, গবেষণার মাধ্যমে, সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের কিছু বিষয়ও তুলে ধরা হয়, যার লক্ষ্য কর্মচারীদের ক্রয় ক্ষমতা এবং সবচেয়ে দুর্বল সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে রক্ষা করা।
জিএসইই লেবার ইনস্টিটিউটের মতে, বর্তমান অর্থনৈতিক নীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হল, ক) মূল্যস্ফীতি হ্রাস, খ) মূল্যস্ফীতির ন্যায্য বণ্টন এবং গ) জিডিপিতে মন্দার প্রভাব এড়ানো, যা ফলস্বরূপ আর্থিক ঝুঁকিকে উদ্দীপিত করবে। জ্বালানি সংকট এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যুক্ত জীবনযাত্রার ব্যয়ের কারণে গ্রিক সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের তীব্রতাও রয়েছে।
এমআরএম/জিকেএস