ঘুমের ঘোরে রগে টান
আমি চিকিৎসক না তবে রোগী, সেক্ষেত্রে আমি চিকিৎসকের অস্তিত্ব্রের প্রধান কারণ। কিছু কি বোঝাতে পারলাম? আমাদের শরীরের যতো নেটা, মানে শারীরিক যতো অসুস্থতা, তার কারণেই গোটা বিশ্বে ডাক্তারের উৎপত্তি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে চিকিৎসকরা তো আন্দাজে ওষুধ দেবেন না। তাদের জানতে হবে সমস্যা কী এবং সমস্যার জন্য কী ধরনের সমাধান রয়েছে।
এই জানা বা শেখার কারণে তারা ভুরি ভুরি বই পুস্তক পড়েছেন, ফলে তাদের কাছে গেলে আমরা রোগ মুক্তির সমাধান পেয়ে থাকি।
এখন আমার সমস্যা একটু ভিন্ন ধরনের, সেটা হলো সমস্যা আছে কিন্তু সমাধান নেই। এজন্য কোথায় বা কার কাছে যাবো? এমন জটিলতার সময় যুগে যুগে কিছু মানুষ নানাভাবে ছুটেছে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় তার জন্য। অনেকে দিনরাত ভাবতে ভাবতে পাগল হয়েছে, অনেকে বাথ ট্যাব থেকে ল্যাংটা হয়ে ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করতে করতে জনসমাজে নিজেকে কেলেংকারি করেছেন, শেষে বিশ্বখ্যাতি পেয়েছেন ইত্যাদি।
পৃথিবীতে যুগে যুগে সমস্যা এসেছে আর তার সমাধান খুঁজতে যারা জীবনের পুরো সময়টি ব্যয় করেছেন তাদের মধ্যে সবাই যে সাকসেস হয়েছেন তা না, শুধু যারা সফল হয়েছেন তাদের কথাই আমরা জানি। বর্তমান তাদেরকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হচ্ছে যা অতীতে ছিল না।
আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ, দিনে এনে দিনে খাই। আমার আবার সমস্যা বেশি। কিছু কিছু সমস্যার সমাধান নেই যেমন মাঝে মধ্যে পায়ের রগে টান পড়ে, তাও আবার ঘুমের ঘোরে, সে যে কী ব্যথা! তারপর ঘুমের বারোটা বাজে। কী করি, কোথায় যাই? ওষুধ নেই তবে লাখো মানুষের মতামত আছে, এটা করো, ওটা করো, সেটা করো ইত্যাদি। করতে করতে শেষে নিজেই বসেছি লিখতে কী করা যেতে পারে।
আসুন জেনে নেই কে কী বলছেন এবং শেষে আমার মতামত। তার আগে জেনে নেই দুটি সমস্যা। একটা ভেরিকোজ ভেন অন্যটি ঘুমের ঘোরে পায়ের রগে টান পড়া। কী কারণে এ সমস্যা এবং এ রোগ প্রতিরোধের কী সম্ভাব্য সমাধান রয়েছে? দৈনন্দিন জীবনযাপনে, যাদের পায়ে প্রচুর চাপ পড়ে, তারাই ভেরিকোজ ভেন ও পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
ভেরিকোজ ভেনের উপসর্গ বলতে, পায়ে ব্যথা বা অস্বস্তি ও ভারিভাব, গোড়ালি ফুলে যাওয়া, ত্বকে বাদামি দাগ হওয়া। এগুলো হলো প্রাথমিক উপসর্গ। বিশ্রামের সময়ে পা উঁচুতে রাখা দরকার এবং বসে থাকার সময়ে পা-দুটিকে কোনাকুনি করে না-রাখাই উচিত। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নারী এর শিকার হন।
আর্টারিতে ফ্যাট জমে, রক্তপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে পায়ে চাহিদা মতো রক্ত সরাবরাহ হয় না। তাই পায়ে ব্যথা করে। একে আর্টারি ডিজিজ বলা হয়। এই রোগের অন্য লক্ষণ হলো, শরীরের অন্য অংশের তুলনায়, পায়ের নীচে বা পায়ের পাতায় ঠান্ডাভাব, পায়ের আঙুল, পাতা বা পায়ের ক্ষত যা সারতে সময় লাগে এবং নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
এর থেকে মুক্তি পেতে, স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইলের সঙ্গে নিয়মিত পরিশ্রম করা দরকার। কোলেস্টেরল আর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকা দরকার। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখাও দরকার। প্রয়োজনে সার্জারিতে যেতে হতে পারে। তবে সার্জারির তখনই প্রয়োজন, যখন উপসর্গ খুব তীব্র হয়, হাঁটা বা দাঁড়িয়ে থাকার মতো সাধারণ কাজকর্মও আর করা সম্ভব হয় না।
রাতে ঘুমের মধ্যে অনেক সময় রগে টান লাগে বা পেশীর সংকোচনে ক্র্যাম্প হয় এবং ঘুম ভেঙে যায়। এ রকম হওয়ার কারণ কী এবং কীভাবে এই সমস্যা দূর করা যায়? কল্পনা করুন যে আপনি রাতে শুয়ে আছেন এবং আপনার নীচের অংশটি ধরেছে। ব্যথা যথেষ্ট তীব্র। এটি হালকা হতে দেয় না এবং আপনার পেশীটি স্পর্শ করা হলে শক্ত মনে হয়।
রাত্রিকালীন লেগ ক্র্যাম্পগুলি প্রাপ্তবয়স্কদের ৬০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভাবিত করে। কখনও কখনও পায়ের এক বা একাধিক পেশী অনিচ্ছাকৃতভাবে শক্ত হয়। লেগ ক্র্যাম্পগুলি হয় যে পেশীগুলো পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু পর্যন্ত পেছনের দিকে থাকে মূলত সেখানে।
বেশিরভাগ সময়, পেশী দশ মিনিটের কম সময়ে শিথিল হয়। রাতে ঘন ঘন ক্র্যাম্পগুলি আপনার ঘুমকে ব্যাহত করে। ঘুমের সময় লেগ ক্র্যাম্প মহিলাদের এবং বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। রাতের লেগ ক্র্যাম্পের একটি বিশেষ কারণ হতে পারে ভেরিকোজ ভেনের উপসর্গ যার ফলে উপরে সমস্যাটি তুলে ধরেছি।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, রাতের লেগ ক্র্যাম্পগুলি ইডিয়োপ্যাথিক, এর কারণটি এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। রাতের বেলা পায়ে ক্র্যাম্পগুলি পায়ের অবস্থানের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। আমরা আমাদের পা এবং পায়ের আঙ্গুলগুলি আমাদের দেহের বাকি অংশগুলো থেকে দূরে রেখে ঘুমিয়ে থাকি। এটি একটি প্লান্টার ফ্লেকশন বা পায়ের পাতা নিচের দিকে থাকে বলে এটি উপরের পেশীগুলিকে সঙ্কুচিত করে, ফলে এগুলি আরও সংবেদনশীল হয়।
পেশীগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে নিয়মিত প্রসারিত করা দরকার। টিভি দেখা বা দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকার ফলে পায়ের পেশীগুলো ক্র্যাম্পিংয়ের জন্য আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ওষুধের কথা বলা হয়েছে যেমন- ম্যালেরিয়ার ওষুধ সেবন, কারণ তার মধ্যে রয়েছে কুইনাইন, তারপর সিফরোল তবে শতভাগ কার্যকর কোনটাই নয়।
আপনার পাগুলো ভাঁজ করে বা আপনার পায়ের আঙ্গুলগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য চাপে রেখে কাজ করলে পায়ের পেশীগুলো সঙ্কুচিত হয়, যা রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যদিও রাতের বেলা পায়ের ক্র্যাম্প তীব্রভাবে বেদনাদায়ক হতে পারে তবে এগুলি সাধারণত গুরুতর হয় না। বেশিরভাগ মানুষ এর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যার ফলে তাদের চিকিৎসা করার প্রয়োজন নেই।
আমার বাসায় এ সমস্যা দেখা দিয়েছে, রাতের ঘুম এখন হারানোর পথে। দুনিয়ার সব কিছু ঘাটাঘাটি করছি, যার কারণে ডাক্তার না হতে পারলেও পন্ডিত যে হতে চলেছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গতকাল সুইডিশ মিটবল রান্না করছিলাম। সুইডিশ মিটবল সে আবার কী? গরুর মাংসের কিমাকে মসলাপাতি দিয়ে গোল গোল করে ভাজি করে পরে সেটাকে টমেটোর সস, ক্রিম দিয়ে রান্না করে আলু দিয়ে ভোজন।
এবার সামারে ক্ষেতে বাংলা শাকসবজি তৈরি করেছি, সেখানে প্রচুর শসার আবাদ হয়েছে। যদিও শসাগুলো সুইডেনে ভেস্তারোস গুরকা বলে পরিচিত তবে খেতে অবিকল বাংলা শসার মতো। শসাকে পাতলা করে কেটে একটু চিনি, লবন এবং ভিনেগার দিয়ে ম্যারিনেট করে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিলে সারা বছর তা খাওয়া যায় বিশেষ করে সুইডিশ মিটবলের সঙ্গে। সুইডিনে একে বলা হয় ইনলাগদ গুরকা।
আমি সচরাচর এটা এর আগে নিয়মিত খেয়েছি বলে মনে পড়ে না তবে ইদানীং রীতিমতো খেতে চেষ্টা করছি। কারণ কী জানেন?
এটা খাবার কারণে রাতের ক্রাম্প কমতে শুরু করেছে। কী কারণ বা রহস্য জড়িত এর পেছেনে? ইনলাগদ গুরকায় রয়েছে শসা, যার মধ্যে আছে ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম এবং ভিটামিন ‘কে’। শসাতে আছে ফসফরাস যা হরমোন নিয়ন্ত্রণকারীর মূল পুষ্টি উপাদান।
ভিটামিন বি ওয়ান, ভিটামিন বি ফাইভ এবং ভিটামিন বি সেভেন শসাতে পাওয়া যায়, যা উদ্বেগ ও চাপ কমাতে সাহায্য করে। ত্বক মলিন ও শুষ্ক ত্বক সতেজ করতেও শশা সাহায্য করে। ইনলাগদ গুরকায় রয়েছে লবণ, যার মধ্যে আছে সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন,পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম ইত্যাদি।
ইনলাগদ গুরকায় রয়েছে ভিনেগার, ফলের রস দিয়ে ভিনেগার তৈরি করা হয়। ওজন কমাতে, ক্লান্তি দূর করতে, ডায়বেটিস কমাতে, হজমে সহায়তা, অনিদ্রা দূর করতে ভিনেগার সাহায্য করে। ইনলাগদ গুরকায় রয়েছে চিনি, যাতে রয়েছে শক্তি, ভিটামিন ইত্যাদি।
সব মিলে গবেষণা চলছে ক্রাম্প দূর করার ওপর।
পৃথিবীতে এভাবেই চাপে পড়ে মানুষ জাতি যুগে যুগে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেছে। সেক্ষেত্রে চাপকে সমস্যা হিসেবে দেখলেও তা থেকেই কিন্তু সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কথায় বলে সমস্যা ততক্ষণ যতক্ষণ আমরা না জানি সমস্যাটি কী, সমস্যা জানা মানে সমস্যা আর সমস্যা না, তখন কী তার সমাধান সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। সচেতন জাতি খোঁজে সমাধান কথাটি আমার খুব প্রিয়, আশাকরি সবার ভালো লাগবে যখন দেখবেন বিপদ এসেছে এবং সেটা সমাধান করা সম্ভব হয়েছে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]
এমআরএম