কানাডার ক্যালগেরি ম্যারাথনে প্রথমবারের মতো তিন বাংলাদেশি
কানাডায় ১৯৬৩ সাল থেকে শুরু হয় ক্যালগেরি ম্যারাথন, যা বর্তমানে কানাডার দীর্ঘতম এবং অন্যতম জনপ্রিয় ম্যারাথন প্রতিযোগিতা। সর্বশেষ ২০১৯ সালে সশরীরে এই ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মাঝে বৈশ্বিক মহামারির কারণে ২০২০ সালে ভার্চুয়ালি প্রতিযোগিতাটি হয়। আর এ বছর দুই ফরম্যাটেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্যালগেরি ম্যারাথন।
এই ম্যারাথনে দুই বছরের শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ সবাই বিভিন্ন দূরত্বের দৌড় কিংবা হাঁটায় অংশ নিতে পারেন। এই প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দূরত্বের মধ্যে আলট্রা (৫০ কিমি), ফুল (৪২.২ কিমি) আর হাফ (২১.১ কিমি) ম্যারাথন দৌড় সর্বাধিক জনপ্রিয়।
সদ্য সমাপ্ত ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় ক্যালগেরিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতা ছিল। এবারের ১৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ফুল ম্যারাথন ক্যাটাগরিতে প্রথমবারের মতো তিনজন বাংলাদেশি অংশ নেন। তারা হলেন- ক্যালগেরিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি ড. খোকন সিকদার ও নবাংশু শেখর দাস এবং বাংলাদেশ থেকে আগত প্রশান্ত রায়।
ম্যারাথনের শুরু থেকে শেষ অব্দি লাখো প্রাণের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে দেশকে ভালোবাসা আর সম্মানে সিক্ত করেছেন তারা। উল্লেখ্য, এবারের প্রতিযোগিতায় করোনার বিধিনিষেধের মধ্যেও প্রায় ৭ হাজার ৫০০ জন প্রতিযোগী অংশ নেন।
তিন বাংলাদেশির পরিকল্পনাটা ছিল ২০১৯ থেকেই, তবে বাস্তবায়নটা থমকে যায় কোভিড-১৯ ভাইরাসের মহামারির কারণে ২০২০ ক্যালগেরি ম্যারাথন সরাসরি না হয়ে ভার্চুয়ালি হওয়ার কারণে। এবছরও ক্যালগেরি ম্যারাথন দুই ফরম্যাটে হয়েছে ভার্চুয়ালি আর সরাসরি। তবে শুরু থেকেই একটা শঙ্কা ছিল আদৌ সরাসরি অনুষ্ঠিত হবে কিনা, কিন্তু এর মাঝেও এই তিন বাংলাদেশি তাদের ট্রেনিং সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের স্বপ্ন ছিল একটাই- ক্যালগেরি ম্যারাথনে বাংলাদেশের মানচিত্র বুকে নিয়ে দৌড়ে চলা।
এ প্রসঙ্গে প্রভিন্সিয়াল গভর্নমেন্টে কর্মরত স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ড. খোকন সিকদার বলেন, কানাডার মাটিতে আমরা তিন বন্ধু বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক ম্যারাথনে অংশ নিয়ে একদিকে যেমন প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি সম্মান জানাচ্ছি, অপরদিকে দেশের মানুষদের একটিভ লিভিংয়ে অভ্যস্ত হতে প্রেরণা জাগাতে চাচ্ছি। বাংলাদেশের জেলায় জেলায় এমনকি উপজেলা শহরগুলোতে দৌড়, সাইক্লিংসহ বিভিন্ন একটিভ জীবনযাপনের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং এর প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত। এতে করে প্রায় সব বয়সী মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস আবার ফিরে আসবে। অল্পতেই অসুস্থ হওয়া, ঘন ঘন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে, এবং যুবসমাজের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা কমে আসবে।
২০২১ এর ক্যালগেরি ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বুকে নিয়ে দৌড়ের স্বপ্ন নিয়ে প্রশান্ত রায় হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ঢাকা থেকে ক্যালগেরি এসেছেন।
৪২.২ কিলোমিটার শেষে ফিনিশ লাইনে এসে প্রশান্ত রায়ের অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি শুধু একটি কথাই বললেন, স্বপ্ন পূরণ, এবং তা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বন্ধু খোকন সিকদারের একান্ত ইচ্ছায়। তিনি আরও যোগ করেন, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার অন্যতম উপায় হাঁটা অথবা দৌড়। এর কোনো বিকল্প নেই। অনেকেই এটাকে কষ্টের মনে করেন, কিন্তু শুরু করলে যে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি আসে, তা উপলব্ধি করার পর কেউ এটা ছাড়তে পারবে না। ডাক্তার ও ওষুধ এড়াতে চাইলে নিয়মিত হাঁটা এবং দৌড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। পরিশেষে বলতে চাই, ছোট ভাই নবাংশুর উৎসাহ আমাকে ফিনিশ লাইন পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রাণবন্ত করেছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ক্যালগেরি ম্যারাথন দৌড় ২০২১ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে ধরতে পেরে প্রবল উচ্ছ্বসিত নবাংশু শেখর দাস। তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরিতে পিএইচডি গবেষণারত। তার কাছে দৌড়টা হচ্ছে মানসিক চাপ দূর করার এক হাতিয়ার। তাই ল্যাবের কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই এক চক্কর দৌড় দিয়ে আসেন। তবে ম্যারাথনে দৌড়ের চিন্তা এবং উৎসাহ আসে ড. সিকদারের সঙ্গে ২০১৮ সালে পরিচয়ের পর থেকেই। আর লাল সবুজের পতাকা উড়ানোর পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের ধাপগুলো চূড়ান্ত হয় প্রশান্ত রায়ের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
প্রবাস জীবনে গত চার বছরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নবাংশু মনে করেন পরিবার পরিজন ছেড়ে এক নতুন সামাজিক এবং একাডেমিক পরিবেশে অনেক সময়ই মানসিক অবসাদ চলে আসে। আর এর থেকে পরিত্রাণ পেতে একটিভ লিভিংটা খুবই জরুরি। নবাংশু বিশ্বাস মনে করেন, সুস্থ দেহেই সুস্থ মনের বাস। ম্যারাথন দৌড়ের ফিনিশ লাইন অতিক্রম করার পরে নবাংশু বলেন, বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা বুকে নিতে ফিনিশ লাইনে দাঁড়ানো ছিল আমার জীবনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। আগামীতে আরও ভিন্ন ভিন্ন ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে নবাংশু আরও বলেন, আমাদের এই বাংলাদেশি তিন বন্ধুর ফুল ম্যারাথনে অংশগ্রহণ ক্যালগেরি তথা বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি করবে বলে আশা করি।
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা ক্রমেই জনপ্রিয় উঠছে। স্থিতি সরাসরি মৃত্যু না ঘটালেও যন্ত্রনির্ভর আমাদের দৈনন্দিন স্থবির জীবন চর্চা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রধান হুমকি। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে একটিভ লিভিং বা সচল জীবনযাত্রার বিকল্প নেই। আর তাই তো প্রবাদে আছে, গতিই জীবন, স্থিতিই মরণ।
এমআরআর/জিকেএস