মালয়েশিয়ার ৬৪তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
হারি মারদেকা-২০২১, মালয়েশিয়া পা রাখল স্বাধীনতা লাভের ৬৪তম বার্ষিকীতে। এবারের স্লোগান- ‘মালয়েশিয়া পিরিহাতিন’ (মালয়েশিয়া য্ত্নশীল)। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে দেশটি। মালয়েশিয়ার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম গৌরব ও অহংকারের দিন এটি।
প্রতি বছর দিবসটি উদযাপনে প্রশাসনের পাশাপাশি জন সাধারণের মধ্যেও দেখা যায় ব্যাপক প্রস্তুতি। রাজধানী কুয়ালালামপুর শহরসহ রাজ্যে রাজ্যে ছেয়ে যায় জাতীয় পতাকা। করোনা মহামারির প্রভাবে নানান বিধিনিষেধ আরোপ হলেও এ দিবসটি পালনে কোনো কমতি নেই।
করোনাভাইরাসের কারণে এসওপি মেনে দেশ প্রেমের আশা জাগানিয়ায় পারিবারিকভাবে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে মালয়েশিয়ানরা দিবসটি উদযাপন করছেন। মালয়েশিয়ান পরিবার ভার্চুয়ালি দিবসটি পালনের আয়োজন করে। আয়োজনে, মাল্টিমিডিয়া মন্ত্রী আনুয়ার মুসার গানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় দিবসটির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা। আলোচনায় মন্ত্রিপরিষদের মন্ত্রীরাও যোগ হয়েছিলেন।
দেশটির রাজা সুলতান আব্দুল্লাহ, দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহামারি সংকট উত্তরণে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে পুত্রাজায়া ন্যাশনাল ওয়ারিয়র স্কোয়ারে জাতীয় দিবস উদযাপনে প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব এবং তার স্ত্রী দাতিন সেরি মুহাইনি জয়নাল আবিদিনও ‘কেয়ারিং মালয়েশিয়া’ বিষয়ক অনুষ্ঠানে অনলাইনে যোগ দিয়েছিলেন, কার্যত তিনি কোভিড-১৯ রোগী তার সংস্পশে আসার কারণে গতকাল থেকে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন।
এদিকে সকাল ৮টায় রয়্যাল মালয়েশিয়ান নেভির (আরএমএন) সদস্যরা জালুর জেমিলাং, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে উত্সব শুরু হয়। এরপরে রুকুন নেগারা পাঠ করারপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লুকমান আলহাকিম মোহাম্মদ তমিয়াসের নেতৃত্বে বিভিন্ন ফ্রন্টলাইন এজেন্সি এবং বিভাগের প্রতিনিধিরা ‘মারদেকা’ স্লোগান দিতে থাকেন।
এর আগের দিন প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব, দেশের জনসাধারণ একত্রিত হওয়ার এবং দেশকে কোভিড-১৯ মহামারির ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে পুনরুজ্জীবিত করতে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আসুন আমাদের দেশকে এই মহামারি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে মুক্ত করি।
উল্লেখযোগ্য দিনে, আসুন সবাই জাতি, ধর্ম বা জাতিগততা নির্বিশেষে আমরা যে দেশটিকে একসঙ্গে গড়ে তুলেছি সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দেই। আশিয়ানের প্রাণকেন্দ্র মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ। যার মোট আয়তন ৩,৩০,০০০ বর্গকিলোমিটার। মোট ১৩টি প্রদেশ এবং তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চল আছে।
জনসংখ্যা ৩২.৭ মিলিয়ন। মাথা পিছু আয় ১২১৫০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে উন্নত রাষ্ট্র ঘোষণা করার টার্গেট অর্জন করতে সক্ষম না হলেও ২০৩০ সালে উন্নত রাষ্ট্র ঘোষণা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। চীন, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ডের জল ও স্থল সীমান্ত ঘেরা মালয়েশিয়ার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রয়েছে শক্তিশালী অবস্থান।
পর্যটকদের প্রথম পছন্দের দেশ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর বিশ্বের সেরা কসমোপলিটন সিটি। মালয়েশিয়ার সরকারি ভাষা মালয় হলেও চাইনিজ ও তামিল ভাষার প্রাধান্য স্বীকৃত। সবাই ইংরেজিতে কথা বলতে পারে।
সাংবিধানিক রাজা দেশটির প্রধান হলেও সরকার প্রধান নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচিত সংসদ আছে। প্রাদেশিক সরকার আছে এবং রাজা নির্বাচিত হয় প্রাদেশিক সুলতানদের মধ্য থেকে যা মালয়েশিয়ার ঐক্যকে করেছে সমৃদ্ধ।
রাজা মালয়েশিয়ার জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। মালয়েশিয়া মুসলিম দেশ হলেও এখানে চাইনিজ মালয়েশিয়ান এবং ইন্ডিয়ান মালয়েশিয়ান যার অধিকাংশই খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় সম্প্রীতি মালয়েশিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য দান করেছে। শ্রম, সেকেন্ড হোম বা বাণিজ্যিক কারণে মালয়েশিয়ায় অনেক অভিবাসী রয়েছে।
মালয়েশিয়ার অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত মুক্ত। গত ৩০ বছরে দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে মালয়েশিয়া একটি উঠতি শিল্প উন্নত বাজার অর্থনীতি বলে বিবেচিত। বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শতভাগ কর্মসংস্থান থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে বেকারত্ব বেড়ে গেছে। মালয়েশিয়া ব্যাপকভাবে ঘুরে দাঁড়াবে বলে বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা আভাস দিয়েছে।
এরই মধ্যে করোনাকালে সরকার ৪টি বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ দিয়েছে এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করছে ক্রমশ। পর্যটন শক্তিশালী অর্থনৈতিক খাত হলেও করোনা কারণে এখন কোনো পর্যটক মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারছে না। মেডিকেল পর্যটন রয়েছে মালয়েশিয়ার।
মানব সম্পদ উন্নয়ন করতে মালয়েশিয়া বদ্ধপরিকর। আন্তর্জাতিক মানদন্ড রক্ষা করতে এরই মধ্যে কর্মীদের কল্যাণে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বেতন ভাতা বৃদ্ধি বীমাসহ নিরাপত্তা ও বিদেশি কর্মীদের ক্ষেত্রে শূন্য অভিবাসন এর দিকে ধাবিত হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। কারিগরি শিক্ষায় সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেশীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়া ক্যাম্পাস করেছে ফলে অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী আছে। চিকিৎসা শিক্ষায় অনেক উন্নতি করেছে।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দাতুক সেরি ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে প্রতিযোগিতার আছে। ক্ষমতার পালাবদল থাকলেও মালয়েশিয়ার উন্নয়নে ধারাবাহিকতা চলে আসছে।
মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এবং এই অঞ্চলের মধ্যে মালয়েশিয়াই সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের যাত্রা তখন থেকেই। এরপর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মালয়েশিয়া সফরে গেলে দু’দেশের সম্পর্ক আরো মজবুত ভিত্তিতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।
১৯৭৬ সালে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী আসতে শুরু করে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে শ্রম, শিক্ষা, সামরিক, সাংস্কৃতিক এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পর্কের ভিত্তি শক্তিশালী হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। মালয়েশিয়া এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় বাণিজ্য-অংশীদার।
২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় আমদানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৭.২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১১-১২ সালে ছিল মাত্র ৫৬.১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অপরদিকে বাংলাদেশে হাউজিং, টেলিকম, পাওয়ার প্লান্ট এবং ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে মালয়েশিয়া বিনিয়োগ করেছে এবং বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বিনিয়োগ অংশীদার যার পরিমাণ ৮১৫.৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য উভয় দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বাংলাদেশ মালয়েশিযা থেকে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল আমদানি করে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার শ্রম সম্পর্ক সম্প্রতি নবমাত্রা পেয়েছে বিশেষ করে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়া সফর করেন এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশকে লেবার সোর্স কান্ট্রির স্বীকৃতি দেয়।
এরপর জি-টু-জি প্লাস চুক্তি করে যার আওতায় তিন লক্ষাধিক বাংলাদেশির নতুন করে কর্মসংস্থান হয়। অপরদিকে দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে চলা রিহায়ারিং প্রোগ্রামের আওতায় তিন লক্ষাধিক বাংলাদেশি বৈধতা ও কাজ পায়, অন্যথায় এদের খালি হাতে দেশে ফিরে যেতে হত।
বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়া সরকার অবৈধদের নিজ দেশে ফিরে যাবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে কোনো ধরনের শারীরিক শাস্তি না দিয়ে কেবল সামান্য আর্থিক জরিমানা আরোপ করে দেশে ফিরে যাবার সুযোগ দিয়েছে। আনডকুমেন্ট অভিবাসী কর্মীদের রি-ক্যালিব্রেশন প্রক্রিয়ায় বৈধ হওয়ার সুযোগ চলমান রয়েছে।
উন্নত মালয়েশিয়া বিনির্মাণে বাংলাদেশি কর্মীদের অবদান অনস্বীকার্য। আগামীতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পাবে বলে বাংলাদেশ আশা করে।
এমআরএম/জিকেএস