শুধু স্লোগানে নয়, মাদককে না বলুন সবখানে সবসময়

আম্বিয়া অন্তরা
আম্বিয়া অন্তরা আম্বিয়া অন্তরা , যুক্তরাষ্ট্র
প্রকাশিত: ১২:৪৪ এএম, ২৬ জুন ২০২১

মাদক এখন ফ্যাশনের মতো হয়ে গেছে! শুধু শহর নয়, এর বিচরণ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। যে কোনো পরিবার এবং সমাজের জন্য মাদকসক্ত ব্যক্তি হুমকি স্বরূপ। টাকা না পেলে তারা ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে। মাদকের ভয়াল দশা এবং প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৬ জুনকে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

পরের বছর থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এক এক বছর এক এক স্লোগান সামনে রেখে পালিত হয়। গত বছর বাংলাদেশে করোনার কারণে দেশব্যাপী অত্যন্ত সীমিত পরিসরে দিবসটি পালন করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। তবে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদকবিরোধী প্রচার কার্যক্রম চালানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।

মাদকের সর্বব্যাপী বিস্তার ঠেকিয়ে তরুণ প্রজন্মকে এর অভিশাপ থেকে রক্ষায় বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ৪ মে দেশজুড়ে বিশেষ অভিযান শুরু করে র্যাব। এরপর পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাও মাদকবিরোধী অভিযান চালায়। অভিযানে এখন পর্যন্ত কয়েকশ ব্যক্তি মাদক কারবারে জড়িত থাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়।

গ্রেফতার হয় কয়েক হাজার, তবু মাদক নির্মূল করা যায়নি। কারবার চলছেই। করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারিও মাদককে রুখতে পারেনি। মাদকের ব্যবহার আদিকাল থেকেই ছিল। কিন্ত সেটি আধুনিকালের মাদকের মতো নয়। তখনকার মানুষেরা গাছ-গাছালী থেকে নেশাদ্রব্য তৈরি করে ব্যবহার করত। কিন্তু এ ধরনের মাদকের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সীমিত আকারে।

jagonews24

যারা তৈরি করতে পারত বা মাদকের ব্যবহার সম্পর্কে জানত এ ধরনের মাদক শুধু তারই ব্যবহার করত, বাজারজাত করা হত না। প্রাকৃতিক উদ্ভিদ থেকে ‘আফিং’(পপি ফুলের বীজ থেকে তৈরি), ‘ভাং’, ধুতরা পাতা থেকে তৈরি নেশা দ্রব্য, ভাত পঁচিয়ে তৈরি ‘চুয়ানি’,তালের রসের ‘তাড়ি’ মানুষ নেশা হিসেবে ব্যবহার করত।

শ্রেণিভেদ অনুযায়ী মানুষ এ ধরনের নেশাদ্রব্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে ছিল তামাক পাতার ব্যবহার তামাকের মাধ্যমে ধূমপান। এই তামাক পাতার ব্যবহারে ধূমপানটি করা হত হুক্কার (নারিকেলের খুলি ও কাঠের ছিদ্রযুক্ত লম্বা লইচার তৈরি)। তবে এ ধরনের নেশাকে বেশিরভাগ মানুষ ঘৃণার চোখে দেখত।

এ উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের শেষাবধি সময় পর্যন্ত মাদক ব্যবহারের বিস্তার তেমন একটা ঘটেনি। মুসলিম শাসন পর্যন্ত ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়েই মাদকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত ছিল। এজন্য ভিন্ন কোনো আইন প্রণীত ছিল না। পাক-ভারত উপমহাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে ব্রিটিশরা। এই ইংরেজ শাসকদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার সঙ্গে ছিল মদ। মদ খাওয়াটা তাদের জন্মগত ও
পারিবারিক বৈশিষ্ট ছিল।

ওই দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ ধরনের পরিমিত অ্যালকোহল (মাদক) পান তারা করত শারীরিক প্রয়োজনে। সেটি কখনও মাত্রারিক্ত ছিল না। এদেশে এসেও তাদের জীবন-যাপনে এর ধারাবাকিতা বজায় রেখেছিল। ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশায় ধনীক, বণিক, আমলা, ভূস্বামী, জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়।

তারা ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশায়, আতিথেয়তার অনুষ্ঠানে, ক্লাবে গিয়ে ধীরে ধীরে মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠে। অভ্যস্ত হয় মদ্যপানে। ইংরেজরাও দেশের মানুষের চরিত্র হননে, উঠতি ধনীক শ্রেণির মাঝে মাদক ও নারী লোভের এক সংস্কৃতি তৈরি করে। এ ধরনের মাদকাশক্তদের জন্য ইংরেজদের ব্যাপক পরিমাণ মদ ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করতে হত।

তাদের শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘকালীন টিকিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে এ ধরনের সংস্কৃতি ফলপ্রসূ হওয়ায়, তারা এর পরিধির ব্যাপকতা সৃষ্টির জন্য সে সময়ে উপমহাদেশের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শহর, নগর ও বন্দর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় মাদকের অবাধ ব্যবসা। এর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করা হয় পতিতালয়।

পতিতালয়ে পাশাপাশি বিভিন্ন শহর বন্দর এলাকায় স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে অ্যালকোহল তৈরির জন্য গড়ে তোলা হয় কারখানা। সে সময়ে পূর্ববঙ্গে এ ধরনের একটি অ্যালকোহল কারখানা বৃটিশরা তৈরি করেছিল। এ ধরনের স্থাপিত একটি কারখানা বর্তমানে কুষ্টিয়ায় স্থাপিত কেরু অ্যান্ড কোঃ (কেরু কোম্পানি)।

এ ধরনের কারখানায় অ্যালকোহল তৈরিতে সাধারণত চিটাগুড় (গুড় তৈরির বৈর্জ্য), চিনির মিলের চিনি তৈরির বৈর্জ্য এবং নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়। এর পাশাপাশি ব্রিটিশ আইন করে এর উৎপাদন, বাজারজাত করণ ও বিক্রি ব্যবস্থার প্রচলন করে। এজন্য আইনের মাধ্যমে এজন্টে, ডিলার ও বিক্রির জন্য লাইসেন্স প্রদান করা হয়।

যে আইনের কাঠামোয় থানায় লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এই আইনের পরিকাঠামোয় (কিছু সংশোধনী সাপেক্ষে) ইদানীং শোনা যায় আধুনিক নেশা শিশা, ইয়াবা, ফেনসিডিল ইত্যাদি। আমাদের মূল চালিকাশক্তির একটি বড় অংশ মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রগতি ও সমৃদ্ধির অন্তরায়।

এখনও স্বাধীন বাংলাদেশে টিকে আছে মাদক নিয়ন্ত্রক অধিদফতর। অথচ এর মাঝে আমরা দুই দুইবার স্বাধীনতা লাভ করেছি। দু দুইবার আমাদের সংবিধান রচিত হয়েছে। কিন্তু মাদককে আমারা একবারে না বলতে পারিনি। যদিও দেশে নানাবিধ সামাজিক সংগঠন এ ভয়াল দশা রুখতে যুব সমাজকে সচেতন করে তুলতে চেষ্টা করছে।

দেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য সরকারি রিহ্যাব কেন্দ্র আছে অথচ যারা ঝুঁকে পড়ছে বা পড়বে তাদের ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্বেগজনক পদক্ষেপ এখনো অদৃশ্যমান।

আশা রাখব এ বছরের দিবসটিকে সামনে রেখে সরকার নতুন আঙ্গিকে নতুন পরিকল্পনায় মাদকতা কমিয়ে আনার চেষ্টায় সচেষ্ট থাকবেন। শুধু স্লোগানে নয়, মাদককে না বলুন সবখানে সবসময়।

এমআরএম/এমআরআর

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]