বিশ্ব মিডিয়ায় সমালোচিত মোদি, অস্বস্তি প্রবাসী ভারতীয়দের
সৈয়দ আতিকুর রব, আয়ারল্যান্ড থেকে
করোনার মহাপ্রলয়ে ভারতের সামাজিক এবং অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। ভাইরাসটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমে তার নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।
গত সাত বছরে মোদি যেভাবে বুক উঁচু করে বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন সেই মোদি আজ চরম নাস্তানাবুদ হতে হয়েছেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার মোদির ভাবমূর্তি পতন ঘটেছে অনেকটা নীরবে। পাশাপাশি সম্প্রতি ভয়াবহ করোনা সংকটের কারণে ভারতের ভাবমূর্তি যে তলানিতে ঠেকেছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
সম্প্রতি ব্রিটেনের সানডে টাইমস এমন একটি শিরোনাম করেছে, ‘ভারতকে লকডাউন থেকে বের করে মোদি কোভিড কেয়ামতের দিকে নিয়ে গেলেন’। ভারতের মতো বিশ্বের এত বড় একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এই ধরনের শিরোনাম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ইতোপূর্বে আর কখনও হয়নি।
বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটের সম্পাদকীয়তেও মোদি সরকারের নজিরবিহীন সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘জাতীয় বিপর্যয় ডেকে আনার জন্য মোদির নেতৃত্বই দায়ী’। সংকটের সময় তিনি যা করেছেন তাতে মনে হয়েছে, কোভিডের মোকাবিলার চেয়ে টুইটারের সমালোচনা মুছতেই তার ব্যগ্রতা বেশি। তার এই অপরাধ অমার্জনীয়।
বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, আল-জাজিরাসহ বিশ্বের অন্যান্য গণমাধ্যমেও এভাবেই মোদিকে তুলোধুনো করা হয়েছে। অথচ এর আগে এসব গণমাধ্যম মোদির চলমান হিন্দুত্ববাদী নীতির সমালোচনা করলেও তার শাসনব্যবস্থা নিয়ে তেমন প্রশ্ন তোলেনি। বরং মোদির নেতৃত্বে ভারতের অগ্রসরমান অর্থনীতির প্রশংসা করা হত এসব গণমাধ্যমে।
কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে ভারতের চলমান কোভিড বিপর্যয়ের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে মোদিকেই দায়ী করা হচ্ছে। অথচ এর আগে নরেন্দ্র মোদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু করোনা সংকটে তার এই ভাবমূর্তি ভেঙে পড়েছে।
ব্রিটিশ ত্যাগের পর স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় এই বিপর্যয় শুধু স্বাস্থ্য খাতেই নয়, দেশটির অর্থনীতিও ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সারি সারি লাশের মাতমে ভারতীয়দের নাগরিক জীবনে বিরাজমান ছিল শোকের ছায়া।
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১৯৫২ সালের পর সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হয়েছে। দেশটির ২৩ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, করোনা সংকটের কারণে দেশটি অনেক বছর পিছিয়ে গেছে।
এর ফলে রাজনৈতিকভাবেও চরম বিপদে পড়েছেন মোদি। বহুমুখী আক্রমণে তিনি অসহায়। মোদি সরকারের প্রতি রাষ্ট্রের আস্থা এতটাই তলানিতে ঠেকেছে যে অক্সিজেন সংকট কাটাতে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে বাধ্য হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
এ সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনাস্থারই নামান্তর। করোনা সংকট নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি যেভাবে মোদি সরকারকে চোখ রাঙানি দেখিয়েছে তা কিছুদিন আগেও ছিল অচিন্ত্যনীয়। এতে বোঝা যাচ্ছে যে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর মোদির লাগাম দিনদিনই আলগা হয়ে পড়েছে।
সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় দেশের বেসামাল হওয়ায় নিয়ে রাগ, ক্ষোভ, হতাশা রয়েছে ৬১ শতাংশ ভারতীয়ের। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে এই তথ্য। এছাড়া ৪৫ শতাংশ মনে করেন সংক্রমণ ঠেকাতে দেশ যে কৌশল নিয়েছে তা ভুল। অথচ করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর মোদির জনসমর্থন ৮০ ভাগের ওপরে ওঠেছিল।
ফরেন পলিসির এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, মোদি যে আত্মনির্ভর ভারতের স্লোগান কপচাতেন তাও এখন একটা ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে। দেড় দশক পর এই প্রথম ভারত বিদেশি সাহায্যের জন্য হাত পেতেছে। সংকট নিরসনে বাংলাদেশসহ ৪০টি দেশ ভারতকে সহায়তা দিয়েছে।
অচিন্তনীয় এই সংকট মোদিকে নিদারুণ উপহাসের পাত্র করে তুলেছে। মহারাষ্ট্রের শিবসেনাও কটাক্ষ করে বলেছে, ‘মোদির ভারত এতটাই আত্মনির্ভর যে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাকেও আজ সাহায্যের হাত বাড়াতে হচ্ছে!’ কংগ্রেসের গুণগান করে শিবসেনার মুখপত্র সামনা লিখেছে, ‘৭০ বছর ধরে নেহরু-গান্ধীর দল যে ব্যবস্থা তৈরি করে গেছে, দেশ বেঁচে রয়েছে তারই বদৌলতে।’
এই বিপদের পাশাপাশি মোদি-শাহ জুটির এ যাবৎ নির্মেঘ আকাশে ছেয়েছে রাজনৈতিক হতাশাও। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জোড়া ধাক্কায় বিজেপি কাত হয়ে পড়েছে উত্তর প্রদেশেও। তার ঠিক আগেই হতাশ করেছে কর্ণাটক পৌরসভার ভোট। স্বশাসিত সেই রাজ্যের ১০টি বড় শহরের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে মাত্র একটি। ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠে ছয়টি দখল করেছে কংগ্রেস।
বিজেপি মুসলিমবিরোধী নেতা যোগী আদিত্যনাথের শাসিত উত্তর প্রদেশের পঞ্চায়েত ভোটে শীর্ষে উঠে এসেছে সমাজবাদী পার্টি। জেলা পরিষদের মোট ৩ হাজার আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে মাত্র এক–চতুর্থাংশ। মাত্র সাত মাস পরই উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব ও উত্তরাখণ্ড বিধানসভার ভোট। কৃষক আন্দোলন ও করোনায় লেজেগোবর হওয়া বিজেপি তিন রাজ্যেই প্রমাদ গুনতে শুরু করেছে।
ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিলন বৈষ্ণব বিবিসিকে বলেছেন, মোদির দক্ষতা নিয়ে অনেক মানুষই এখন প্রশ্ন তুলছেন। সমস্যা মোকাবিলায় মোদি সরকার যে কেবল অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে তারা সংকটকে আরও গুরুতর দিকে নিয়ে যেতে ভূমিকা রেখেছে।
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্লারি বলেন, মোদির জাতীয়তাবাদী ঝোঁকের সঙ্গে একধরনের সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার একটি ছবি সবসময় বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সামনে তুলে ধরা হত। কিন্তু কোভিড সংকটে এই সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। মোদির জীবনী-লেখক এবং সাংবাদিক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, গুজরাটে মোদির দ্যুতি দেখে সবাই মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। আমি নিজেও এই ভুল করেছি।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মোদির বর্মতে যে আসলে অনেক ছিদ্র, সেটা এই সংকটে প্রকাশ পেয়েছে। তারা বলছেন, যে ধরনের এককেন্দ্রিক স্টাইলে তিনি দেশ চালান সেটা বেশ ফাঁপা বলে মনে হচ্ছে। মোদি ভারতকে একটি পরাশক্তিতে পরিণত করার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু এখন ভারতীয়রা দেখছেন থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশও কোভিডের বিরুদ্ধে অনেক ভালোভাবে লড়াই করছে। পরাশক্তি হবার মেকি স্বপ্ন মোদির রয়েই যাবে।
বিদেশে থাকা ভারতীয়রা এখন খুবই বিব্রত। বন্ধুদের কাছে যে দেশটিকে তারা এক উদীয়মান শক্তি বলে তুলে ধরেছিলেন, সেই দেশটিকে এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেভাবে দেখানো হচ্ছে সেটা নিয়ে লজ্জায় তাদের মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে।
এই বিপর্যয়ের সময় মোদি যে সবকিছুতে অনুপস্থিত, সেটাও বেশ ভালোভাবেই ধরা পড়ছে। গত ২০ এপ্রিলের পর থেকে মোদি দৃশ্যত লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন। অথচ ভারতের প্রতিদিন করোনায় মারা যাচ্ছে অন্তত হাজার হাজার মানুষ। অনেকে বলছেন, এই সংখ্যা আসলে কয়েকগুণ বেশি।
মোদির ব্যর্থতার সমালোচনা করে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের কভিড-১৯ টাস্কফোর্স কয়েক মাসে বৈঠকে মিলিত হয়নি। মোদি এবং তার মন্ত্রীরা সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন যে ভারতে করোনা শেষ হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর কিছুদিন আগে গত জানুয়ারিতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ভার্চুয়াল বৈঠকে মোদি ঘোষণা করেছিলেন, তার দেশ করোনার বিরুদ্ধে লড়াইযে জয়ী হয়েছে। করোনাভাইরাস কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ভারত একটি বড় বিপর্যয় থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করেছে। অথচ ভাগ্যের পরিহাস হচ্ছে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন এখন বিশ্বের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।
ভারতের নজিরবিহীন অক্সিজেন সংকট ও শশ্মানে হাজার হাজার লাশের স্তূপ আর নদীতে লাশের সারি ভারতের ভাবমূর্তিকে আফ্রিকার কোনো অতি দরিদ্র দেশের কাতারে নিয়ে গেছে। ভারতের বড় বড় শহরের আকাশ দিনরাত ধূসর হচ্ছে বিরামহীন জ্বলতে থাকা শশ্মানের আগুন আর ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, মোদির এ ব্যর্থতা একান্তই তার। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরিবর্তে তিনি আনুগত্য দেখে মন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন। তার সরকার স্বচ্ছতার পরিবর্তে গোপনীয়তার নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আর এ ধরনের সরকার কাঠামোয় মোদি কোনো বল মিস করলে তার ফল হয় বিপর্যয়কর। করোনা মহামারিতে তাই দেখা গেছে।
ফরেন পলিসি বলছে, মোদি ভারতের করোনা টিকা রফতানি নিয়ে যে কূটনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছিলেন তা বুমেরাং হয়েছে। বিভিন্ন দেশকে চুক্তিমত টিকা না দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচিত হয়েছে। অথচ টিকা রফতানির শুরুতে প্রতিটি প্যাকেটের গায়ে মোদির ঢাউস সাইজের ছবি দিয়ে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো।
‘মোদির বৈশ্বিক স্বপ্নের মৃত্যু’ শিরোনামে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের নিবন্ধে বলা হয়েছে, ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তির যে ক্ষতি এই সংকটে তৈরি হয়েছে তা সারাতে বছরের পর বছর লেগে যাবে। আর মোদি যাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন সেই জয়শঙ্করের পক্ষে এটা সারানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
সম্প্রতি মোদি সরকারের আরেকটি নিউজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও নজর কেড়েছে। সেটি হচ্ছে, মুসলিম ব্যতীত সব ধর্মের নাগরিকত্ব দেবে ভারত। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি এই ধরনের একটি নির্দেশিকা জারী করা হয়েছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আগত অমুসলিম উদ্বাস্তুরা ভারতের নাগরিক হওয়ার জন্য সেই আবেদন করতে পারবেন বলে জানিয়েছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গুজরাট, রাজস্থান, ছত্রিশ গড়, হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবের ১৩টি জেলায় বসবাসকারী মুসলিম ব্যতীত হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ প্রকৃতির বাসিন্দারা ভারতের নাগরিকত্ব লাভের আবেদন করতে পারবেন বলে জানিয়েছে বিজিপি সরকার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানা গেছে, নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ এবং ২০০৯ সালের সংশোধনকৃত নাগরিকত্ব আইনের আওতায় শিগগির এই নির্দেশিকা কার্যকর করা হবে। উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত ২০১৯ সালে সংশোধিত বির্তকিত নাগরিকত্ব আইন চালু করা সম্ভব হয়নি দেশটিতে।
কোভিডের কারণে অক্সিজেন সঙ্কট আর সৎকারের জায়গার ব্যাপক অভাবে নরেন্দ্র মোদির পরাজয়ের সীমানা ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে ওঠছে ভারতে। হিন্দুত্ব নয়, ব্যবস্থাপনা এবং সুশাসনের নীতি না শিখলে নরেন্দ্র মোদিকে এর চড়া মূল্য দিতে হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
এমআরএম/জিকেএস