চাঁদের গায়ে দাগ লেগেছে আমরা ভেবে করব কী
সংসার, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পাশ্চাত্যে দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী মাঝে মধ্যে কিছুদিনের জন্য একা থাকে বা ভ্রমণে বের হয়। অনেকে একত্রে বসবাস করলেও দেখা যায় তারা তাদের নিজ নিজ বাসাবাড়িটি ধরে রাখে। অনেকেই অর্থনৈতিক ভাবে সেল্ফডিফেন্ডেড।
অনেকের ধারণা সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকার কারণে সম্পর্কের অবনতি হয়। একাধারে যদি দিনের বেশির ভাগ সময় একসঙ্গে থাকা হয়, তবে কখনো কখনো ভালোবাসা বৃদ্ধির বিপরীতে কিছু একঘেঁয়েমি, কিছু ভুল বোঝাবুঝি, কিছু রাগ, অভিমান এবং শেষমেশ ঝগড়াঝাটি পর্যন্ত হয়।
স্বামী–স্ত্রী নিজেদের মাঝে আলাদাভাবে একটু জায়গা করে নিতে চেষ্টা করে। যখন মনে করে একেবারে একান্তই তাদের আলাদা কিছু সময় দরকার তখন সেটা করে থাকে। তাতে নিজের জীবনে অন্যজনের গুরুত্ব অনুধাবন করার কিছুটা সময় পেয়ে থাকে।
খুব বেশি দিন একসঙ্গে দিনরাত থাকার যেমন সুবিধা আছে, অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধাও আছে। একসঙ্গে থাকলে মাঝেমধ্যে চরম বিরক্তি এবং পরস্পরের প্রতি অনাগ্রহ আসতে পারে। তবে এমন নয় যে ভালোবাসা আসে না। এটা সবার ক্ষেত্রে নয়, তবে অনেকের ক্ষেত্রে হয়।
করোনা প্যান্ডামিকের সময় লকডাউনের কারণে স্বামী–স্ত্রী একটা দীর্ঘ সময় কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেয়েছে। শুরুর দিকে ব্যাপারটা বেশ সাবলীল ও রোমান্টিক হলেও আস্তে আস্তে বিরক্তির কারণ বেড়েছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গা দিন দিন হারিয়েছে। নানা ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি ব্যাপক হারে বেড়েছে। শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে গিয়ে নিষ্পত্তি হয়েছে।
আবার একেবারে কাছাকাছি থাকলেই যে শ্রদ্ধাবোধ চলে যায়, তা-ও নয়। মানুষ হয়তো একটু পরিবর্তন চায়। আসলে অনেক পরিবারে অনেকের রুচিবোধ আলাদা।
সংসার করবেন অথচ ঝামেলা হবে না, তা তো নয়। অল্পস্বল্প সমস্যা থাকবে, তা নিয়েই চলতে হবে। তবে সহ্যের সীমা অতিক্রম করলেই বিচ্ছেদের প্রশ্ন আসে।
কেন ইদানীং বেশি বিচ্ছেদের আবেদন হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ নারী বিচ্ছেদের আবেদনে উল্লেখ করেছেন, স্বামীর সন্দেহবাতিক মানসিকতা, পরকীয়া, স্বামীর উদাসীনতা, যৌতুক, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি।
অন্যদিকে স্বামীর পক্ষে আবেদনের ক্ষেত্রে স্বামীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের ইচ্ছায় চলা, ফেসবুকে আসক্তি, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি কম মনোযোগ দেওয়া, ধর্মকর্মে উদাসীনতা, বন্ধ্যাত্বসহ বিভিন্ন কারণ দেখানো হয়েছে।
এসব তত্ত্ব আগামী দিনের জন্য ভয়াবহ।
একটা বিচ্ছেদ মানে কেবল দুজন আলাদা হওয়া নয়। একটা পরিবারের বিচ্ছেদ, বাচ্চাদের বিচ্ছেদ। তবে একেবারে নিরূপায় হয়ে গেলে বিচ্ছেদ ছাড়া উপায়ও থাকে না।
লকডাউনের কারণে দিনের পুরো সময়ই স্বামী-স্ত্রী কাছাকাছি থাকছেন। তাতে করে ছোটখাটো বিষয় নিয়েও পরস্পরের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিচ্ছে। এমনকি অন্য সময় হলেও খুব কাছাকাছি থাকলে, সন্দেহবাতিকতা, ফেসবুক নিয়ে সন্দেহ, পারস্পরিক সম্মান ইত্যাদির ঘাটতি থাকে বিধায় ছোটখাট ঝগড়া বিচ্ছেদে গড়ায়।
বেশির ভাগ বিচ্ছেদ মধ্যবিত্তসহ, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী পরিবারেও হচ্ছে। এটা শুধু পাশ্চাত্যে নয় গোটা বিশ্বের সমস্যা বর্তমানে।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কে একটু জায়গা দরকার। নিজেদের কিছুটা আলাদা সময় দরকার। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, মূল্যায়ন, সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ দেখানো দরকার। সংসারে সবকিছু যে একজনের ভালো লাগায় হবে, তা কেন? কখনো কখনো অন্যের ভালো লাগার গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনা বিল গেটস এবং তার স্ত্রী মেলিন্ডার বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে বাংলাদেশে যেভাবে লেখালিখি চলছে বিশ্বের অন্য কোথাও তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা অন্যের সমস্যায় বেশ জড়িয়ে পড়ি। শিক্ষণীয় হলেও কথা ছিল বরং পরনিন্দা এবং পরচর্চায় মগ্ন থাকাটা কেমন যেন নেশা এবং পেশা হয়ে দাড়িয়েছে।
বিল গেটস এবং তার স্ত্রী যত ধনীই হোক না কেন তারাও তো মানুষ। ভালোবাসা যে সবার জন্য সমান এবং সেটার ভাঙ্গন শুধু গরীবদের ক্ষেত্রে হয়, এ জীবনে কোনোদিন শুনিনি বা দেখিনি। বিল গেটসের পরিবার আর দশজন পরিবারের মতো, যদিও অনেকের কাছে সেটা বিশ্বাস হবে না।
তাদের ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে, আগের মত যৌথ দায়িত্ব কর্তব্য হয়ত নেই। অতীতে যেমনটি এক সঙ্গে কাজ করেছে এখন তেমনটি নয়। যৌবনের জোয়ার এখন হয়তো ভাটায় যেতে শুরু করেছে, যার কারণ হতে পারে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ। "অলির কথা শুনে বকুল হাসে, কই তাহার মত তুমি আমার কথা শুনে হাসো না তো।"
জীবনে যখন হাসি তামাশা না থাকে তখন নিভে যায় আলোর ঘর। যাই হোক না কেন যদি শিক্ষণীয় কিছু না থাকে তবে কেন এত জল্পনা কল্পনা? চাঁদের গায়ে যদি দাগ পড়তে পারে তবে কেন তাদের জীবনে দাগ পড়বে না? ভালোবাসা সেতো একদিনের জন্য নয়, ভালোবাসা প্রতিদিনের ব্যাপার, প্রতিক্ষণের ব্যপার।
জীবনে শুধু অর্থ নয় দরকার স্বার্থেরও সেদিকে নজর দিতে হবে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ভালোবাসায় রয়েছে শুধু ভালোবাসা, সুতরং মন খুলে প্রিয়জনকে ভালোবাসুন। এই ভালোবাসা হোক কিছুটা ভিন্ন ধরনের যেমন খাবারের টেবিল বা বসার ঘরে। একটু সুন্দর করে সাজিয়ে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দিন।
এতে করে একটা আলোছায়ার পরিবেশ তৈরি হবে। সেই আলোছায়াতে প্রিয়জনের সঙ্গে মুহূর্তগুলো হয়ে উঠবে আরও রঙিন। রেস্টুরেন্টগুলোও এখন সে রকম খোলা নেই। কিন্তু ঘরে কিছু মজার খাবারের আয়োজনে কিছুটা ভিন্নতা আনতে পারেন বা পিকনিক করতে পারেন।
দুজনেই হয়তো একে অন্যের পছন্দের কোনো খাবার রান্না করলেন বা বানালেন নিজের মতো করে। তারপর সেটা নিয়ে বসলেন আড্ডা দিতে। একে অন্যের পছন্দ–অপছন্দকে গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে এর থেকে ভালো উপায় আর কী-বা হতে পারে!
তবে রান্নাবান্না ঠিক আপনার কর্ম না হলে বাইরে থেকে খাবার অর্ডারও করে নিতে পারেন। বিল গেটস আর মিলেন্ডার বিচ্ছেদ নিয়ে তামাশা ছেড়ে বরং নিজের জীবনসঙ্গীর সঙ্গে আনোন্দময় কিছু মুহূর্ত কাটান দেখবেন ভালো লাগবে।
লকডাউনে এক সঙ্গে থাকার মাঝে যে মজা, জীবনে এ সুযোগ হয়ত আর নাও আসতে পারে, এমন সুযোগ হেলায় হারানো কি ঠিক হবে?
চাঁদের আলোয় রাত যেমন আলোময় হয়ে যায়, ঠিক তার মতো একে অপরের একান্ত সময়ে ভালোবাসার মাঝে হারিয়ে যাওয়া ক্ষণিকের তরে, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]
এমআরএম