অসুস্থ প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যাচ্ছে মানসিক প্রশান্তি
কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে বেশি মানুষকে যে সুখী করতে পারে, সেই সবচেয়ে বেশি সুখী।’ যে কাজ চারপাশের মানুষের জীবনকে আনন্দময় করে, তার তৃপ্তি মানুষকে দেয় গভীরতম প্রশান্তি।
চাপ আর চাপ। আর তার চিরসখা অস্থিরতা। এটাই তো এখন আমাদের জীবন। অনার্সে অল্পের জন্য ফার্স্ট ক্লাস হয়নি, মাস্টার্সে না পেলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পদোন্নতি হয়ে গেল পাশের টেবিলের সহকর্মীর। এমন সময়ে কেবলই মনে হতে থাকে, আমরা ক্রীতদাস এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার। মনকে চেপে ধরে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা। এ যুগে প্রশান্তি চপল–চরণ আসলেই সোনার হরিণ।
দিনে দিনে আমরা অসুস্থ প্রতিযোগিতা নামক রোগে আক্রান্ত হয়ে বিক্রি করে দিচ্ছি সোনালী সকাল, রূপালী বিকেলগুলো। ব্যক্তি, সামাজিক, চাকরি-বাকরি, ব্যস্ততা, অসুখ-বিসুখ সবকিছু মিলিয়ে মানসিক চাপ সৃষ্টির ফলে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যকে পরাজিত করে এক ধরনের আনন্দ পাওয়ার মনোভাব শেখানো হচ্ছে। জিপিএ ৫ পাওয়ার এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিশুরা বেড়ে উঠছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
মানসিক অশান্তির বেড়াজালে আটকে বিসর্জন দিতে হয় আনন্দ, সুখ-শান্তি, মায়া-প্রেম, ভালোবাসা। আমাদের কাছে একান্ত নিজের সময় বলতে যা থাকে তা আমরা ব্যয় করি আশপাশের মানুষগুলোর সঙ্গে অহেতুক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে।
কলিগের লেটেস্ট মডেলের মার্সিডিজ, বিএমব্লিউ, নান্দনিক বাড়ি দেখে আর ভালো লাগে না, প্রতিহিংসার মেতে ওঠি। তখন ব্যাংক লোন নিয়ে গাড়ি কিনি অহেতুক অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে। সেই টাকা যথা সময়ে পরিশোধ নিয়ে আবার ব্যাপক হতাশায় থাকি। কেন গাড়ি পরিবর্তন করি এমন প্রশ্ন আমাদের মাথায় আসে না।
কে কত দামের গ্যাজেট ব্যবহার করে। কার কত ব্যাংক ব্যালেন্স আছে, কার ছেলে-মেয়ে কোন স্কুলে পড়ে, কার রেজাল্ট কত ভালো প্রতিযোগিতায় আমাদের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। কখনও কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে অমানুষে রূপান্তরিত হয়ে হারিয়ে ফেলছি নৈতিক মূল্যবোধ।
শুধু বড় হতে হবে এই আমাদের দৈনিক স্লোগান, অথচ কিসের পেছনে দৌড়াচ্ছি আমরা সেটাও জানি না। অন্যের সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রভাবে দিনে দিনে জীবন হয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক। নিজেকে কখনো কখনো রোবট বানিয়ে ফেলছি। যান্ত্রিক জীবনে আমাদের লক্ষ্যই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিযোগিতা। সবদিক থেকেই যেন নিজেকে সেরা দেখতে চাওয়াই এখন মূল লক্ষ্য।
উদ্দেশ্যহীনভাবে মূল লক্ষ্য যখন ভুল লক্ষ্য থাকে তখন অহেতুক প্রতিযোগিতার মাঝে তৈরি হয় হতাশা। কখনো কখনো প্রতিহিংসা নিষ্ঠুরতা যার কারণে সঙ্গী হয় ভয়ঙ্কর এক একাকিত্ব।
সেই সকাল ১০ থেকে বিকেল ৫টা, সারাদিন কাজ করে তারপর আবার মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমরা চিন্তা করি আমার কলিগদেরকে কত টাকা বেতন পায়, কার কয়টা গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদি।
ঘরে আমাদের জন্য অপেক্ষায় বসে আছে তাকেও সময় দেই না। নিজেকে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রেখে প্রিয়জনের পাশে শুয়েও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে বিক্রি করে দিচ্ছি সুখ-শান্তি।
প্রিয়জনের আনন্দ ফেলে কৃত্রিমে আমরা অমানুষ হয়ে যাচ্ছি। অফিস, মিটিং, সেমিনার, অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতা এত ব্যস্ত জীবন কি একজন মানুষের হওয়া উচিত? কখনো নিজের আয়নায় প্রশ্ন করা হয় না।
কয়েকদিন আগে দেখলাম অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষ। আরো ভয়ঙ্কর লাগলো যখন দেখলাম দেশের ৮২ শতাংশ তরুণ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেন হতাশ তা যদি স্পষ্ট না থাকে তাহলে নিশ্চয়ই দিনের একটা সময় তাদের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে কাটে।
এই প্রতিযোগিতা নামক সংক্রামক থেকে একটু ভিন্ন পথে নিজেকে প্রভাবিত করায় জীবন।
আসুন সর্বদা নিজেকে সুখী ভেবে চিৎকার করে বলি আমি পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ। জীবনকে নতুনভাবে চিন্তা করি। বেঁচে থাকার আনন্দে বেঁচে থাকি। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নিজেকে না জড়িয়ে উৎফুল্ল থাকি। ব্যক্তি যত উৎফুল্ল, তার কাজ করার ক্ষমতা ততবেশি। অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে প্রসারিত হওয় হতাশা আর দুঃশ্চিন্তাকে মুক্তি দিয়ে আমরা বেড়ে উঠি নিজেদের মতো করে নিজের মানদণ্ডে।
এমআরএম/জিকেএস