অদৃশ্য শ্রম : সমাজে নারীর মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি

আম্বিয়া অন্তরা, নিউর্য়ক থেকে
সাংসারিক ও গৃহস্থালির কাজে নারীরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় আট ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। অর্থমূল্যে পরিমাপ না হওয়ায় মজুরিহীন এ কাজের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। স্বীকৃতিহীন এ কাজের অর্থমূল্য পরিমাপ করলে তা পুরুষের আয়ের তিনগুণ হত।
২০১৩ সালের জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সবাই নারী ছিলেন। তবুও সমাজে আমাদের নারীদের এগিয়ে চলা পাথর কেটে পথ বানানোর মতো কঠিন।
নারীর জীবন যাপনের সঙ্গে এই শব্দগুলো অবলীলায় জুড়ে আছে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও যৌতুক নামের মরণব্যাধি। এ রকম কত শত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নারীরা দাঁড়িয়ে আছে নানা প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে।
নারীর অদৃশ্য কাজের স্বীকৃতি দেয়া না হলে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে না। নারীর সমতার কথা বলা হয়, সমদর্শিতার কথা কখনও বলা হয় না। অথচ সমদর্শিতার প্রতিষ্ঠা না হলে সমাজ থেকে কখনও বৈষম্য যাবে না।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো যারা কর্মজীবী নারী, যারা নরম হাতে ইট বালি সিমেন্ট নিয়ে কাজ করে আর কাজের বাইরে যাওয়ার আগে নিজের ইচ্ছেমতো খেতেও পারে না। এর কারণ বাহিরে টয়লেট খোঁজার বিড়ম্বনা। একটা পরিসংখ্যান মতে প্রায় ৭৫ শতাংশ নারীরা নিতান্তই অসচেতনতার কারণে ব্যক্তিগত ইনফেকশন নিয়ে চলে।
পরিবারের জন্য এত উদারতা থাকার পরেও নারীদেরকে সমাজে এড়িয়ে চলে অবলীলায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, যেসব কাজের জন্য কোনো ধরনের পারিশ্রমিক দেয়া হয় না, সে রকম কাজের তিন চতুর্থাংশ এখনো নারীরা হাসিমুখে করে থাকি।
খুব দৃশ্যমান একটা উদাহরণ বললে এমনটি বলতে হয় আমরা যারা গ্রামে থাকি গ্রামের অধিকাংশ পরিবার কৃষিনির্ভর, আর এই কৃষিনির্ভর পরিবারের পুরুষরা মনে করে তারা বাহিরের সব কাজ করে সংসারের অর্থনৈতিক যোগান দেয়।
কিন্তু তারা এভাবে কখনো ভাবে না কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত যেমন ধান সিদ্ধ করা, রোদে দেয়া শুকানো, ঝাড়ু দেয়া এমনকি এগুলো বাজারজাত করার প্রক্রিয়া সব মেয়েদের করতে হয়। বাহির থেকে শ্রমিক এনে যখন ধান রোপণ করতে হয় তাদের খাবার দাবারের ব্যবস্থাও নারীদের করতে হয়। আমাদের গ্রামের অনেক পরিবার হোটেল ব্যবসা করে থাকেন। হোটেলের অনেক ধরনের খাবার আমরা বাড়ি থেকে তৈরি করে দেই সেক্ষেত্রে আমাদের এই পরিশ্রমের কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না।
আমাদের এই কাজগুলো করার পাশাপাশি সন্তানদের যত্ন এবং সন্তানদের যোগ্য নাগরিক করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের নিতে হয়। বড় পরিবারগুলোতে অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়িদের দেখাশোনা করতে হয়। এত কিছুর পরেও নিজের সামান্য শখ পূরনোর জন্য স্বামীর কাছে থেকে কিছু টাকা চাইলে মাথা নিচু করে চাইতে হয়।
আমি দীর্ঘ একটা সময় ঢাকায় মহাখালী, কড়াইল বস্তি, বাড্ডা, লিংকরোড এবং কুড়িল বিশ্বরোডে কর্মজীবীদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করেছি। তাদের কাছে থেকে জেনেছি প্রায় নারীদেরকে দিয়ে পুরুষরা বিভিন্ন এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে জুয়া খেলে সংসারের নাজেহাল অবস্থা করে রাখে।
কখনো কখনো নারীরা যখন বাহির থেকে কিছু উপার্জন করে পুরুষদের কাছে তার কানাকড়িরও হিসেব দিতে হয়। আর এই হিসেব একটু এদিক-সেদিক হলে তা নিয়ে সংসারে ঝামেলা লেগে যায়। গ্রামগুলোতে একটা বিষয় ভালো করে দেখেছি নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা এখনো কমেনি। তার অধিকাংশ কারণ যৌতুক প্রথা আর এটা হয়ে থাকে সাধারণ নারীরা স্বাবলম্বী না হওয়ার কারণে। যে কারণে নারীর একান্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ করে পুরুষরা।
বাংলাদেশে থাকাকালীন দীর্ঘ কয়েক বছর আমি ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল গ্রামের নারীদেরকে এই ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া কিন্তু তখন আমাদের গ্রামের কুসংস্কারের ভেতরে বেড়ে উঠা পুরুষরা সাপোর্ট করেনি। তাই বহুদিন চলতে থাকা এই গল্পের মোড় আবার আমাদের ঘুরিয়ে দিতে হবে।
কারো করুণা বা দয়া নয় বরং আমাদের মানসিক দৃঢ়তায় পারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের পথ নিজেই তৈরি করতে। নারীরা কারো দয়ার পাত্রী না হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করতে হবে। আমরা যারা ভালো রান্না করতে পারি তারা ফুড হোম ডেলিভারির মাধ্যমে ছোট ছোট অনুষ্ঠানের রান্নার দায়িত্ব নিতে পারি। হরেক রকমের পিঠা খাবার বানিয়ে তা বিক্রি করতে পারি এবং আমরা যারা ভালো সেলাই কাজ পারি তারা সামান্য পুঁজি দিয়ে উপার্জন করতে পারি।
আমাদের যাদের হাতের কাজ ভালো তারা ফুল, শো-পিস, পাপস, ফুলদানি, কার্ড, ওয়ালমেট এসব তৈরি করে বিক্রি করতে পারি। বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রায় দশ কোটি ৯১ লাখ মানুষের মধ্যে নারী প্রায় সাড়ে ৫ কোটি। মোট কর্মক্ষম জনশক্তির অর্ধেকের বেশি নারী হলেও কর্মবাজারে আসার সুযোগ হয়েছে মাত্র ২ কোটি। অর্থাৎ মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ সরাসরি কর্মবাজারে আসতে পেরেছি।
তা অনেকটা নারীদের নিজ উদ্যোগে আর বাকি সাড়ে ৩ কোটি নারী পরিবারের বোঝা হয়েই থাকতে হচ্ছে পরিবারের স্বার্থে। নিজের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবার সমাজ রাষ্ট্র আমাদেরেকে ওইভাবে সহযোগিতা করছে না। নানাবিধ ট্যাবু তথা কুসংস্কারকে কেন্দ্র করে আর যদি আমাদের প্রতি দায়িত্ববান হত তাহলে আমরা দেশের মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি ঘটাতে পারতাম এবং মুক্তি পেতাম।
আমাদেরকে উপযুক্ত পরিবেশ এবং পারিবারিক কাজের চাপ থেকে কিছুটা মুক্তি দিলে নিজেরা নিজেদের মত করে স্বাবলম্বী হয়ে শ্রমবাজারের অংশগ্রহণ করতে পারতাম। তাই রাষ্ট্রের উচিত নারী এবং পুরুষ একই সমার্থক শব্দ ব্যবহার করে নারীর প্রতি ভালোবাসার হাত প্রসারিত করা।
বেগম সুফিয়া কামাল বলেছেন, ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার। যে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী, সেখানে নারীদের বাদ দিয়ে উন্নয়ন, অগ্রগতির চিন্তাও করা যায় না। আমাদের নারীরা ক্রমাগত অবদান রেখে চলেছেন। এই অবদানের কারণে এগোচ্ছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র।
নারীর এই অবদানগুলো সব সময় আমরা দেখতে পাই না। পোশাক শিল্পে নারী অবদান রাখছেন, তা আমরা দেখতে পাই; কিন্তু নারী তার মজুরিহীন শ্রম দিয়ে অবদান রেখে চলেছেন গৃহস্থালিতে, কৃষিতে এটা আমরা ক’জন ভেবেছি।
সম-মজুরি গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্যায়ন, নারীর প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, এই বিষয়গুলোকে জোর দিয়ে নারী ও পুরুষের সমতা অর্জনের মাধ্যমে সুন্দর সুস্থ একটা দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করা বৈষম্য দূর করে আমাদের জন্য একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে পরিচিয় করিয়ে দেয়া। সবশেষে বলা যেতে পারে নারীকে নারী হিসেবে না দেখে এক একটি নারীকে কর্মীর শক্ত হাত বিবেচনা করে সমস্ত কাজকে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে নিয়ে হিসেব কষতে হবে।
এমআরএম/জেআইএম