রাজনৈতিক বিরোধ: টালমাটাল মালয়েশিয়ার পাম অয়েল খাত

আহমাদুল কবির
আহমাদুল কবির আহমাদুল কবির , মালয়েশিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৩:৫০ পিএম, ৩১ মে ২০২০

রফতানি শ্লথ হয়ে কমে গেছে মালয়েশিয়ার পাম অয়েলের দাম। সংকটে পড়েছেন রফতানিমুখী এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত উৎপাদনকারী ও রফতানিকারকরা। বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে দেশে দেশে চাহিদা ও আমদানি কমে যাওয়া এবং ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে বাজার হারিয়ে টালমাটাল অবস্থায় পড়েছে দেশটির পাম অয়েল খাত।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলোয় মালয়েশীয় পাম অয়েলের দাম বাড়ানো হতে পারে। পণ্যটির সর্বোচ্চ দাম টনপ্রতি ২ হাজার ৪০০ রিঙ্গিত (মালয়েশীয় মুদ্রা) বা ৫৫১ ডলারের ওপরে উঠতে পারে। এমনটাই মনে করছেন মালয়েশিয়ান পাম অয়েল বোর্ডের (এমপিওবি) চেয়ারম্যান আহমেদ জাজলান ইয়াকুব।

৩১ মে ফ্রি মালয়েশিয়া টু-ডেতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যমান চরম সংকটের মধ্যে সম্প্রতি এমপিওবির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন আহমেদ জাজলান। দাফতরিক দায়িত্ব পালনের শুরুতেই তিনি এক বিবৃতিতে বাজার পরিস্থিতি পরিবর্তনের আশার কথা শুনিয়েছেন।

jagonews24

তিনি বলেন, পাম অয়েলের বাজারে ক্ষীণ হলেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে। চীন ধীরে ধীরে আমদানি বাড়াচ্ছে। ভারতের সঙ্গেও বিরোধ কমে আসছে। এ পরিস্থিতি ভারতের বাজার ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোয় পাম অয়েলের বাজার পরিস্থিতি করোনা-পূর্ববর্তী সময়ের মতো না হলেও বর্তমানের তুলনায় কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আগামী মাসের দিকে মালয়েশীয় পাম অয়েলের দাম টনপ্রতি ২ হাজার ৩০০ রিঙ্গিত বা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ৫২৮ ডলার ৩৭ সেন্টের ওপরে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে পণ্যটির সর্বোচ্চ দাম টনপ্রতি ২ হাজার ৪০০ রিঙ্গিত বা ৫৫১ ডলার ৩৪ সেন্ট ছাড়াবে না। বর্তমানে মালয়েশিয়ার বাজারে প্রতি টন পাম অয়েল ২ হাজার ২৩০ ডলারের নিচে বিক্রি হচ্ছে।

পামওয়েল বোর্ডের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বলেন, করোনা মহামারি অন্যান্য খাতের মতো মালয়েশিয়ার পাম অয়েল শিল্পেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র উৎপাদনকারী ও খামারিরা। দাম কমতির দিকে থাকায় অনেক ক্ষুদ্র উৎপাদনকারী আর্থিক লোকসানের শিকার হয়েছেন। তাদের উৎপাদনে ফিরে আসতে এমপিওবির পক্ষ থেকে সহায়তা দেয়া হবে। আর আগামীতে পাম অয়েলের দাম বাড়লে তারা উপকৃত হবেন।

jagonews24

তবে আগামী দিনগুলোয় আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধির পেছনে প্রভাবক হিসেব কাজ করতে পারে ভারত-মালয়েশিয়া। দুই দেশের চলমান বিরোধের শুরুটা মূলত রাজনৈতিক। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দুটি উদ্যোগ মালয়েশিয়ার সঙ্গে বিরোধের সূচনা করে। একটি ভারতের আলোচিত-সমালোচিত ‘নাগরিকত্ব’ বিল। অন্যটি ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের ‘মর্যাদা’ খর্ব করা।

মোদি যখন এ দুটো উদ্যোগের বাস্তবায়ন করেন তখন মালয়েশিয়ায় ক্ষমতায় ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক মাহাথির মোহাম্মদ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথির ‘মুসলিম বিদ্বেষী’ উল্লেখ করে ভারত সরকারের এ দুটি উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করেন। মাহাথিরের একের পর এক ভারত সরকারবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদ করে নয়াদিল্লি।

ভারত জানায়, মোদির এসব উদ্যোগ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাই এসব বিষয়ে ভিনদেশি সরকারপ্রধানের তির্যক মন্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে ভারত সরকারের এমন অবস্থানের পরও থামেননি মাহাথির। মোদির উদ্দেশ্যে একের পর এক সমালোচনার তীর ছুড়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই এ ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে, যা এখনো চলমান। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটে মালয়েশিয়ার মসনদে পালাবদল ঘটেছে।

ক্ষমতা থেকে সরে গেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। মালয়েশিয়ায় নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। ক্ষমতায় এসেই মাহাথির সরকারের অবস্থান থেকে সরে এসে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছেন তিনি।

jagonews24

বিরোধ রাজনৈতিক হলেও শুরু থেকেই পণ্যবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। ভারত মালয়েশীয় পাম অয়েলের অন্যতম প্রধান ক্রেতা। বিরোধের জের ধরে মালয়েশিয়া থেকে পণ্যটির আমদানি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনে ভারত। বিপরীতে ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম অয়েল আমদানি বাড়ায় ভারত। এরপর দেশীয় শিল্প রক্ষার কথা বলে অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করতে ৩৯টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করে দেশটি।

বিশ্লেষকদের মতে, এ উদ্যোগের পেছনে মালয়েশিয়ার সঙ্গে চলমান বিরোধ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। ইন্দোনেশিয়ার পর মালয়েশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ পাম অয়েল উৎপাদক ও রফতানিকারক দেশ। দেশটির রফতানি আয়ের বড় একটি অংশ আসে পাম অয়েল থেকে। বিরোধের জের ধরে অন্যতম শীর্ষ রফতানি গন্তব্য ভারতে বাজার হিস্যা হারিয়ে পণ্যটির রফতানি খাতে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে মালয়েশিয়া।

কূটনৈতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে কুয়ালালামপুর ও নয়াদিল্লির মধ্যে চলছে দফায় দফায় আলোচনা ও চিঠি চালাচালি। এসব উদ্যোগের ইতিবাচক ফলাফল প্রত্যাশা করছেন এমপিওবি চেয়ারম্যান আহমেদ জাজলান। মূলত এ কারণেই তিনি মালয়েশীয় পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা জানান দিয়েছেন।

এমআরএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]