শেষ মুহূর্তে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনে অবৈধ অভিবাসীদের ঢল
সাধারণ ক্ষমা কর্মসূচির শেষের দিকে বাঁধভাঙা ঢল নেমেছে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন অফিসগুলোতে। আর এ ঢল সামলাতে সাপ্তাহিক বন্ধের দিনেও ইমিগ্রেশন বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলছে এই কার্যক্রম।
সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ৮টায় কাউন্টার খোলার আগে, মধ্যরাতের প্রথম দিকে বা তার আগে থেকে বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় রয়েছেন। হাজার হাজার অভিবাসী লাইনে প্রতীক্ষায় থাকলেও একটি ইমিগ্রেশন অফিস থেকে প্রতিদিন গড়ে ইস্যু করা হচ্ছে ৪০০টি ‘স্পেশাল পাস’। বাকিদের লাইনেই থাকতে হচ্ছে পরের দিনের প্রত্যাশায়। কারণ অবৈধ হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে চায় না তারা। তাই প্রতিক্ষা কষ্টের হলেও শুধু জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরার এ সহজ সুযোগ কোনো অভিবাসী হাতছাড়া করতে চায় না।
এদিকে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তিনগুণ বেড়েছে ফ্লাইটের ভাড়া। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় ফ্লাইটে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়ার প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় আকাশ পথের পাশাপাশি সাগর পথেই বেশি লোক ফিরছে।
বাংলাদেশ থেকে সাগরপথে লোক আসলেও যাওয়ার সময় আকাশ পথই একমাত্র উপায়। বাংলাদেশ সরকার টিকিট প্রতি ১২ হাজার বাংলাদেশি টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে। তবে শর্ত হলো, অবশ্যই ট্রাভেল পারমিট থাকতে হবে। এই ভর্তুকির টিকিট বিমানের কুয়ালালামপুরের অফিস থেকে সরাসরি কিনতে হবে। এজেন্টের কাছ থেকে কেনার সুযোগ দেয়নি বিমান। ফলে বাংলাদেশিরা সরকার প্রদত্ত সুবিধা সহজে নিতে পারছে না।
গত ১ আগস্ট থেকে চালু হওয়া ‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচির সুবিধা দিতে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন ইমিগ্রেশন অফিসে ৮০টি বুথ খোলে। ডেটলাইন ৩১ ডিসেম্বর যতই কাছে আসছে, ভিড় ততই বাড়ছে। শুরুর দিকে ভিড় ছিল পুত্রজায়া ও জালান দুতা ইমিগ্রেশনে। অন্যান্য ইমিগ্রেশনে তেমন ভিড় ছিল না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাংলাদেশি ‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে ফেরত যেতে পুত্রাজায়া ইমিগ্রেশন অফিসে টোকেনের অপেক্ষা করছিলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘টানা ৪ দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) স্পেশাল পাস হাতে পাই। এই কয়দিনে গোসল কিংবা খাওয়া-দাওয়া কিছুই করতে পারিনি। পেট বাঁচানোর তাগিদে শুধু রুটি খেয়েছি। কারণ আমি ভয়ে ছিলাম যে, এই লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টোকেন পাবো কি না।’
দুই দফায় ইমিগ্রেশন অফিসে উপস্থিত হয়েও সিরিয়াল না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত টিকিট ফেলে দিতে হলো সিলেটের সুমন চন্দ্র দেব, জামালপুরের ইসমাইল ও ময়মনসিংহের জামালকে।
তারা জানান, ‘আমরা দুই দফা আসার পরও রেজিস্ট্রেশন করতে পারলাম না। মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) রাত ১০টায় এয়ার এশিয়ায় দেশে ফেরার কথা ছিল। স্পেশাল পাস না পাওয়ায় আর যাওয়া হয়নি। বাড়তি কোনো টাকা-পয়সা না থাকায় দেশ থেকে টাকা এনে আবার টিকিট নিয়ে ফিরতে হবে।’
মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের ফেসবুক পেজে পেনাং ইমিগ্রেশন অফিসের তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বিদেশি অবৈধ নাগরিকদের সেবা দিতে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ৪০০ জনকে স্পেশাল পাসে দিতে পারছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ চিত্র কমবেশি সবকটি ইমিগ্রেশন অফিসের। বাকি থেকে যাচ্ছে অনেকেই।
এই বাকিরা আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে স্পেশাল পাস না পেলে কী হবে? এমন প্রশ্ন করছেন অনেকেই। কেউ বলছেন মেয়াদ বেড়েছে, কেউ বলছেন মেয়াদ বাড়বে। এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের মহাপরিচালক দাতো ইনদিরা খায়রুল জাইমি স্পষ্ট বলেছেন, এখন পর্যন্ত ‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচি মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো সিদ্ধান্ত সরকারের তরফ থেকে হয়নি।
বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফিরে যাওয়ার চাহিদাকে বিবেচনা করে এর মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য মালয়েশিয়া সরকারের কাছে অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ হাইকমিশন মালয়েশিয়া সরকারের প্রবর্তিত ‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচির আওতায় অনিয়মিত কর্মীদের দেশে প্রত্যাবর্তনে গড়ে প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩শ ট্রাভেল পাস ইস্যু করা হচ্ছে।
এতো ট্রাভেল পাস এবং পাসপোর্টধারী অবৈধদের ঠিক কতজন সুবিধা নিচ্ছে এমন তথ্য প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন। আগস্ট থেকে শুরু হওয়া সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে গত ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশে ফিরেছেন ৩৯ হাজার বাংলাদেশীসহ ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯০১ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ইন্দোনেশিয়ার ৫৩ হাজার ৩২৮ জন। ভারতের ২২ হাজার ৯৬৪ ও মিয়ানমারের ৬ হাজার ৯২৩ জন। বাকিরা বিভিন্ন দেশের নাগরিক।
এ পরিসংখ্যান উল্লেখ করে ইমিগ্রেশন মহাপরিচালক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অবৈধ অভিবাসীকে ‘বি-ফোর-জি’ পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজ নিজ দেশে ফিরে না গেলে তাদের বিরুদ্ধে অভিবাসন আইনের ১৫(১) ২৯৫৯/৬৩ ধারায় ২ লাখ টাকা জরিমানা ও ৫ বছরের জেল অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে এবং বেত্রাঘাত শাস্তি দেয়া হবে।
তবে যারা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে ইমিগ্রেশনে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে স্পেশাল পাস পাচ্ছেন না তাদের কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘হাইকমিশনার মহ. শহীদুল ইসলামের নির্দেশে ট্রাভেল পারমিট যেদিন আবেদন করছেন সেদিন বিকেলেই দিচ্ছি, সামাজিকে যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছি। বিভিন্নভাবে প্রচার করে লোকদেরকে উদ্বুদ্ধ করছি যেন সরাসরি দূতাবাস ও ইমিগ্রেশন থেকে সেবা নেয়। মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে যাচ্ছি। অনেকে আমাদের কাছে জানাচ্ছে, আমরা ইমিগ্রেশনকে জানাচ্ছি, ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অপরদিকে বিমানবন্দরে গিয়েও অনেকের ট্রাভেল পারমিট সম্পর্কে এয়ারলাইন্সগুলো সন্দিহান হলে সেগুলোও ক্লিয়ার (পরিষ্কার) করে দিচ্ছি। কারণ ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন অন্য দেশের নাগরিক ফলস বা ছবি বদল করে অন্যের ট্রাভেল পারমিট নিয়ে ইমিগ্রেশনে বা বিমানবন্দরে গিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমাদের কাছে রেকর্ড থাকায় তাৎক্ষণিক যাচাই করে এদের থামিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে গ্রেফতার হয়েছে। অনেকে পালিয়ে গেছে। এভাবে হাইকমিশন থেকে ইস্যু করা ট্রাভেল পারমিটে ছবি বা তথ্য পরিবর্তন করে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।’
জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের বিপদগ্রস্ত নাগরিক যাতে সেবা পায় সেজন্য হাইকমিশনার মহ. শহীদুল ইসলাম একটি টিম করে দিয়েছেন।
মালয়েশিয়ার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের তথ্য মতে, গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স অতিরিক্ত ১৬টি ফ্লাইট চালু করেছে। এই ১৬টি ফ্লাইটে ‘ব্যাক ফর গুড’ এর টিকিটধারী যাত্রীরা শুধু এই ১২ হাজার টাকা ভর্তুকি পাচ্ছেন। তবে অধিকাংশ যাত্রী-ক্রেতা জানাচ্ছেন, বিমান অফিসে গেলেও ভর্তুকি মূল্যের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে এ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ বিমান ছাড়া অন্য এয়ারলাইন্সে ব্যাক ফর গুডের যাত্রীরা এ সুবিধা পাচ্ছেন না। এ নিয়ে দেশে ফিরে যেতে যারা অন্য এয়ারলাইন্সে টিকিট করেছে বা যাবে তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে প্রবাসীদের অধিকার ও কল্যাণ নিয়ে সোচ্চার সংগঠনগুলো বলছে, ব্যাক ফর গুডের আওতায় দেশে ফেরত আসছেন এমন সবাইকে এই ভর্তুকির আওতায় আনা হলে কোনো বৈষম্য হবে না। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য করতে পারে না। বৈষম্য করলে তা স্পষ্ট সংবিধানের লঙ্ঘন হবে।
তারা বলছেন, শেষের দিকে যেভাবে বাংলাদেশসহ অন্য ১৬টি দেশের অবৈধ নাগরিকদের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে এ কর্মসূচির মেয়াদ বৃদ্ধি করলে মালয়েশিয়া সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবে।
এমএসএইচ/এমএস