হৃদয়ে যার বসবাস

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:১৭ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

একমাত্র সন্তানকে রেখে প্রেমিকের বাড়ি প্রবাসীর স্ত্রী, সেই প্রেমিক পলাতক। খবরের শিরোনাম চোখে পড়তেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। পত্রিকাটি বন্ধ করে চুপ করে বসে আছি। আমার বউ অন্য কারো সঙ্গে পালিয়ে যায়নি তো! ধুৎ আবোলতাবোল কি ভাবছি এসব! আমার কোনো অর্থ সম্পদ নেই, যা নিয়ে বউ পালাবে সে অভিমান করে বাপের বাড়ি গেছে। কিছুদিন পর নিজেই ফিরে আসবে।

সংবাদের শিরোনাম দেখে মনে হচ্ছে সব দোষ প্রবাসীর। শুধু প্রবাসীদের স্ত্রীই পালিয়ে যায়। যে নারীর বুকে স্বামী সন্তানের জন্য মায়া নেই, ভালোবাসা নেই সে নারী স্বামী দেশে থাকলেও ঘর ছেড়ে যায়। আমার মহল্লার এক বড় ভাই বিয়ে করে সুখেই ছিলেন। তার আট বছরের বিবাহিত জীবনে দুটি সন্তান। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তিনি সুখেই ছিলেন।

কিন্তু সেই সুখ তার কপালে সইল না। কিছুদিন আগে তার স্ত্রী; স্বামী ও সন্তানদের মায়া ও ভালোবাসা ত্যাগ করে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো তার সে প্রেমিকের বয়স প্রায় ৫৫ বছর। একজন বৃদ্ধের সাথে তরুণীর পালিয়ে যাওয়া প্রমাণ করে ভালোবাসার কোনো বয়স লাগে না। সে হয়তো বৃদ্ধের কাছে এমন কিছু পেয়েছে, যা তার স্বামী দিতে পারেনি। এমন অদৃশ্য কিছুর টানেই সে স্বামী সন্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷

আমার স্ত্রী যদি আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যায় আমি সইতে পারব না। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আট মাস হলো বিয়ে করেছি। বউকে নিয়ে মানিকনগর হায়দার আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছাকাছি ছোট একটি বাসায় থাকি। মা-বাবা আর ছোট বোন গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি থাকেন। একদিন মা ডেকে বলেছিলেন, জাহাঙ্গীর তুই শহরে থাকিস হোটেলের খাবার খেয়ে তোর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রেহেনাকে তোর সঙ্গে নিয়ে যা। আমার স্ত্রীর নাম রেহেনা।

আমি মায়ের কথার প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, না মা, তা কি করে হয়! আমার তো চলে যাচ্ছে আপনাদের খেয়াল কে রাখবে!

আসলে এটা আমার মনে কথা না, আমিও চেয়েছিলাম বউ আমার সঙ্গেই থাকুক। কিন্তু মা-বাবার কাছে বউকে সঙ্গে নিয়ে আসার কথা লজ্জায় বলতে পারছিলাম না। আমাদের দেশের ছেলেরা সাধারণত মা-বাবার সামনে একটু লাজুকই থাকে।

মা যখন নিজেই প্রস্তাব দিয়েছেন তখন মনে হয়েছিল মা বুঝি আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। আমরা মা-বাবার মনের কথা না বুঝলেও তারা কিন্তু সন্তানের মনের কথা ঠিকই বোঝেন। সন্তানদের মনের কথা বোঝার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে তাদের।

আমার বউ রেহেনা যথেষ্ট রূপবতী। তাই তাকে রেখে একা থাকতে আমার কষ্ট হতো। রেহেনাকে বিয়ে করে আমি খুশিতে টুইটুম্বর ছিলাম। এমন রূপবতী বউকে রেখে শহরে একা থাকা মানে আমি প্রতি রাত তাকে কাছে পাওয়ার কামনায় নিজেকে কষ্ট দেওয়া। বিবাহিত পুরুষদের জন্য স্ত্রীবিহীন একেকটি রাত হাজার রাতের সমান।

মা-বাবার প্রস্তাবে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বউকে সঙ্গে করে মানিকনগর চলে আসি। আমার আয় কম। আমি একটি গার্মেন্টে কিউসি হিসেবে কর্মরত, যা ইনকাম তা নিজেদের খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা গ্রামে পাঠিয়ে দেই। তবুও বলা চলে আমরা সুখেই ছিলাম। কিন্তু গত সপ্তাহে রেহেনার সঙ্গে সামান্য বাগবিতণ্ডা হয়।

সামান্য বাগবিতণ্ডা বলতে সেদিন অফিস থেকে ফিরতেই বউ আমাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলেছিল, জানু সুসংবাদ আছে। অফিসে কাজ নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় মনটা প্রচণ্ড খারাপ ছিল। তাই রেহেনার এমন আহ্লাদিপনা পছন্দ হলো না। হঠাৎ মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। আমি তার থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলেছিলাম, যা বলার এখানে দাঁড়িয়ে বলো। এমন আহ্লাদিপনা আমি পছন্দ করি না।

‘স্বামীকে জড়িয়ে ধরা কি আহ্লাদিপনা? সবসময় স্বামীকে জড়িয়ে ধরতে নেই। তাদের মেজাজ বুঝে জড়িয়ে ধরতে হয়। এখন তুমি না হয়ে অন্য কেউ আমার সামনে থাকলে কষে চড় দিতাম।’

‘তোমার কাছে আমি এতই তুচ্ছ। প্রয়োজন হলে বুকে টেনে নেবে আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে দূরে ঠেলে কষে চড় দেবে।’

‘হ্যাঁ আমি এমনই পছন্দ হলে থাক নইলে বাপের বাড়ি চলে যাও।’

এরপর বউ আমার সামনে দাঁড়ায়নি। অভিমান করে সেদিন রাতে কারো সাথে কথা বলিনি। পরদিন যথাসময়ে অফিসে চলে যাই। অফিস শেষে বিকেলে এসে দেখি রেহেনা চিরকুট লিখে বাপের বাড়ি চলে গেছে। এই হঠাৎ করে চলে যাওয়াটা আমাকে ব্যথিত করে। যে নারী এত সামান্য ঘটনায় স্বামীর সঙ্গ ছেড়ে চলে যায় সে নারীকে নিয়ে বাকি জীবনটা কীভাবে পাড়ি দেব ভাবতেই মাথায় সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করি।

আজ মনটা ভীষণ খারাপ। রেহেনা চলে যাওয়ার আগে গত এক মাস আমাদের মাঝে সকাল বিকাল তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথাকাটাকাটি হতো। বউয়ের উপস্থিতি আমাকে অস্বস্তি দিত। আসলে গত এক মাস অফিসে একটি ঝামেলা হয়েছে। যেকোন সময় আমার চাকরি চলেও যেতে পারে। অফিসে কাউকে কিছু বলতে পারি না, তাই বাসায় এলে মেজাজ খারাপ থাকে। আমার মতো ভীতু পুরুষরা স্ত্রীর সামনে সাহসী পুরুষ হয়ে উঠি। এই কারণেই গত এক মাস ধরে অফিসের সব জেদ বউয়ের উপর মেটাতাম।

আমি এমন ছিলাম না। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস আমরা ছিলাম সবচেয়ে সুখী দম্পতি। আমাদের ভালোবাসাবাসি দেখে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়ে বলত, ঢং দেখে আর বাঁচি না, যেন এরাই বিবাহিত দম্পতি। জীবনে আর কেহ বিয়ে করে না। আমরা তাদের কথায় কর্ণপাত করতাম না। দু’জন দু’জনকে পেয়ে খুশিতে টুইটুম্বর ছিলাম। এযেন অন্তহীন ভালোবাসাবাসি। কিন্তু হঠাৎ অফিসের ঝামেলার কারণে সব এলোমেলো হয়ে গেলো।

রেহেনা বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার পর আমি তার শূন্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি কিন্তু অভিমান করে তাকে আনতে যাইনি। আর যাবো না। সে তার ভাইয়ের সাথে নিজের ইচ্ছায় গেছে আবার ইচ্ছা হলে ভাইকে সঙ্গে করে চলে আসবে। আমার কি দায় পড়েছে তাকে গিয়ে আনব! অবশ্যই রেহেনা এরই মধ্যে কয়েকবার খবর পাঠিয়েছে আমি যেন তাকে গিয়ে নিয়ে আসি। আমি জবাব দিয়েছি আমি কখনো তাকে আনতে যাবো না।

দরজায় কলিংবেলের শব্দে মনের মধ্যে সুখানুভূতি বইতে লাগল। মনে হলো দরজা খুলেই দেখব রেহেনা অশ্রুভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে। আমার বুকে মাথা রেখে আদুরে গলায় বলবে আমার জন্য কি তোমার একটু মায়া হয়নি। এতদিন তুমিহীনা আমি একটুও ভালো ছিলাম না ৷ তাই সব অভিমান ভুলে তোমার কাছে চলে এসেছি।

আমাকে ক্ষমা করো। কথা দিলাম আর কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না। আমি তার চোখের জল মুছে কপালে চুমু দিয়ে বলব, তুমিহীনা আমিও খুব কষ্টে ছিলাম। সরি আমি অভিমান করে তোমাকে আনতে যাইনি।

কিন্তু এসবই আমার কল্পনা। দরজা খুলে দেখি পাশের বাসার আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন। সে আমার জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। আমি কোনো কারণ জানতে না চেয়ে ধন্যবাদ দিয়ে মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে নিলাম। তিনি বললেন, জানো আমার নাতি হয়েছে। তার চোখেমুখে খুশির জোয়ার দেখে মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। আমার সন্তান হলে মাও বুঝি এমন খুশি হবে। এতদিন সন্তানের অভাব অনুভব করিনি। এখন হঠাৎ সন্তানের পিতা হতে ইচ্ছে করছে।

আন্টি চলে গেলেন। রেহেনা বাসায় থাকলে হয়তো আন্টি রুমে এসে গল্পগুজবে মেতে উঠতেন। নারী হলো ঘরের সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন কত মানুষই না আসে। রেহেনা বাসায় থাকতে প্রতিদিন প্রতিবেশী শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী নারীরা আমার রুমে আড্ডা জমাত। আশ্চর্য আজ এক সপ্তাহ ধরে কেউ আমার রুমের আশপাশে আসেনি। রেহেনা শুধু চলে যায়নি, সঙ্গে করে রুমের সব সৌন্দর্য নিয়ে গেছে। এখন শ্রীহীন রুমের দিকে কেউ উঁকিও দেয় না।

চলবে...

ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর থেকে/এমআরএম/এমকেএইচ

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]