মুক্তিপণ পেয়েও মালয়েশিয়া প্রবাসীকে ছাড়েনি অপহরণকারীরা
বাংলাদেশ-মালয়েশিয়াকেন্দ্রিক একাধিক আন্তর্দেশীয় অপহরণকারী চক্র গড়ে উঠেছে। চক্রগুলো বাংলাদেশিদের টার্গেট করে এবং তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে। এমনি একজন বাংলাদেশির মুক্তিপণ দিয়েও মুক্তি মেলেনি। প্রায় পাঁচ মাস হলেও খোঁজ মিলছে না এখনো।
গত ৬ এপ্রিল তার কর্মস্থলের সামনে থেকে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১০টায় দুর্বৃত্তরা তুলে নিয়ে যায় নেত্রকোনার আল মামুনকে। এর দু’দিন পর ৮ এপ্রিল মামুনের মালয়েশিয়ার ফোন নম্বর থেকে তার স্ত্রীর ফোনে কল করে ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। মামুনের স্বজনদের অভিযোগ, এ ঘটনার সঙ্গে বিদেশি এবং একজন বাংলাদেশি নাগরিক জড়িত।
বাংলাদেশি সেই নাগরিকই ফোনে পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকা চাইত। মামুনের অবস্থাও সে ফোনে জানাত। শেকল দিয়ে পা বাঁধা অবস্থায় তোলা মামুনের একটি ছবি প্রমাণ হিসেবে পরিবারের কাছে পাঠায় অপহরণকারীরা। স্বজনদের ধারণা, ওই বাঙালি ব্যক্তিও অপহরণের সঙ্গে জড়িত।
বাবার সাথে ছেলে ইমনের শেষ ছবি
মামুনের ছেলে নাফিদুল ইসলাম ইমন প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার বাবার সঙ্গে কথা হতো তারই (প্রবাসী ওই বাঙালি) মোবাইল নম্বরে। সেই নম্বর থেকে ফোন করেই টাকা চেয়েছেন। অনেক কষ্টে আমাদের নিকটাত্মীয় আনোয়ারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সেদেশে সাড়ে তিন লাখ টাকা পাঠিয়েছি। পরে আনোয়ার আরেকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অপহরণকারীদের টাকাটা দিয়ে দেয়।’
ইমন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশি সেই লোকটি বলেছিল, টাকা পাওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে বাবাকে তারা ছেড়ে দেবে। কিন্তু টাকা পাঠালেও তারা বাবাকে মুক্তি দেয়নি। আড়াই মাস ধরে বাবার কোনো খোঁজ নেই। এমনকি তার মোবাইল ফোন বন্ধ।’
ইমন বলেন, ‘আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই। এই প্রথম গত দুই ঈদে বাবার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। উনি বেঁচে আছেন, নাকি অপহরণকারীরা তাকে মেরে ফেলেছে, কিছুই জানি না। যদি মেরে ফেলে, তাহলে অন্তত বাবার লাশটা একবার দেখার পর দাফন করতে চাই।’
মামুনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সেন্ট বালাইয়ে সিথিয়াকন বিল্ডিং কোম্পানিতে কাজ করতে যান মামুন। তার কর্মস্থলের সামনে থেকে দুর্বৃত্তরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর দেশে থাকা মামুনের পরিবারের কাছে আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা।
এদিকে স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য সহায়তা চেয়ে গত ২৫ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দিয়েছেন মামুনের স্ত্রী পারুল আক্তার। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, আমার স্বামী আল মামুন (পাসপোর্ট নম্বর বি জে ০৬৫৩৮৩৯) ২০০৭ সালে বৈধভাবে মালয়েশিয়া যান। দীর্ঘদিন যাবত তিনি মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে অবস্থান করছেন। হঠাৎ করে কে বা কারা তাকে তার কর্মস্থলের সামনে থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
এরপর ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় আনুমানিক ৭টার দিকে আমার স্বামীর নম্বর থেকে কল দিয়ে ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। আমরা সাধ্যানুযায়ী সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাই। এরপর থেকে আমার স্বামীর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় আমার স্বামীকে অপহরণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে আপনার সাহায্য কামনা করছি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা বিষয়টি দেখছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দূতাবাস থেকে আল-মামুনকে উদ্ধারের কাজ চলছে। অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে ধরা পড়তেই হবে।
এদিকে মালয়েশিয়াভিত্তিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, ওই দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র তৎপর রয়েছে, যারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসায় জড়িত। এসব চক্রপ্রধান ‘গ্যাং স্টার’ নামে পরিচিত। এসব ‘গ্যাং স্টার’ মূলত মালয়, তামিল, চীনা বংশোদ্ভূত ওই দেশি নাগরিক। যাদের মূল লক্ষ্যবস্তু হলো বিদেশি ব্যবসায়ী ও প্রবাসী শ্রমিকরা।
মালয়েশিয়ার ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টার-এর এক খবরে বলা হয়, ওই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে ৪৯টি ‘গ্যাং’র তালিকা প্রকাশ করে। তবে তখনকার ওই তালিকায় বাংলাদেশি কোনো ‘গ্যাং স্টারের’ নাম ছিল না। ২০১৩ সালের পর থেকে এই চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশিরা সক্রিয় হয়ে পড়ে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এমআরএম/জেআইএম