পর্তুগালের আল-বুফেরা যেন তুলিতে আঁকা এক অন্য দুনিয়া

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:২৯ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

‘কাজ পাগল এবং ভ্রমণ-পিপাসু মানুষ আমি। জীবনে এই দুইটি জিনিসকে কখনো কোনো অজুহাত দেখাইনি। সবসময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসি আর অবসর পেলেই ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। ব্যাকুল হয়ে থাকি কখন সুযোগ আসবে, আসলেই কোনোভাবেই মিস নয়।’

আমার কাজ ও বসবাস পর্তুগালের রাজধানীর শহরতলীর বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায়। লিসবনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় থাকি ফলে দেশের কথা তেমন একটা মনে পড়ে না, মনে হয় দেশের মাঝেই আছি! যেদিকে তাকাই সব আপনজন দেখতে পাই। তাছাড়াও দুই এক বছর পরপর তো দেশে আসা যাওয়া পড়েই।

অফিসের কাজে হঠাৎ প্রয়োজন পড়লো আল-বুফেরা নামক শহরে যাওয়ার। কোনো বিলম্ব না করে যাওয়ার আয়োজন শুরু করলাম কারণ আল-বুফেরা সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জেনেছি।

Portugal1.jpg

আরও পড়ুন > প্রবীণদের কাজে ফেরার সুযোগ দিচ্ছে মালয়েশিয়া সরকার

পর্তুগালের সর্ব দক্ষিণের একটি পর্যটন শহর আল-বুফেরা যা আলগ্রাভ অঞ্চলের অধিভুক্ত এবং লিসবন থেকে প্রায় ২৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এক সময়ের মৎস্য প্রধান গ্রাম এখন বিশ্বের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এই সমুদ্র তীরবর্তী শহরটি বিশ্বের সেরা দশটি পর্যটন শহরের একটি। তাহলে বুঝতেই তো পারা যাচ্ছে কেমন উৎফুল্ল বোধ করছি সেখানে যাওয়ার ও দেখার।

যেহেতু অফিসের কাজে যেতে হচ্ছে তাই একটু তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম যদিও দু’দিনের সফর তবুও প্রথম দিন কাজ শেষ করে ঘোরার সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। লিসবন থেকে কাছের এক ছোট ভাই কাম বন্ধুকে সঙ্গে নিলাম এবং আমার গাড়ি আছে তাই ছোট ভাইয়ের পরামর্শে কার অ্যাপের মাধ্যমে আরও দু’জন যাত্রী নিলাম।

Portugal1.jpg

এখানে বলে রাখি ইউরোপে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়িতে এক শহর থেকে অন্য শহর এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সময় তারা রাইড শেয়ার করে তাতে উভয়েই লাভবান হয়। এখানে সবাই নিজের গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে এবং অনেকে তাদের রাইড শেয়ার করতে পছন্দ করে। কারো মধ্যে কোনো অহংকার কাজ করে না।

সকাল সাতটায় রওনা হয়ে তিন ঘণ্টায় মাঝখানে কফি পানের ১৫/২০ মিনিট বিরতিসহ আমরা পৌঁছে গেলাম ২৬০ কিলোমিটার দূরের শহর আল-বুফেরায়। লিসবন থেকে বাস ও ট্রেন উভয় বাহন আছে আল-বুফেরার যাওয়ার। আকাঁবাঁকা হাইওয়ে বড় বড় পাহাড়ের কোল ঘেঁসে বয়ে গেছে। চারদিকে পাহাড় সবুজ প্রান্তর ও গাছ-গাছালিতে মনোরম এক সুন্দর পরিবেশ এবং তা যেকোনো ভ্রমণ-পিপাসু মানুষের মনকে ছুঁয়ে যাবে অনায়াসেই।

এত মনোমুগ্ধকর রাস্তা ছিল যে ২৬০ কি.মি. তিন ঘণ্টায় পাড়ি দিয়েও শরীরে তেমন কোনো ক্লান্তি আসেনি। বরং শহরে প্রবেশের পরে মন আরও ভরে গেল। লিসবন থেকে যেমনটা কল্পনা করেছি তার থেকে সম্পন্ন আলাদা এক শহর। আবহাওয়া ছিল খুবই চমৎকার চারদিকে সূর্য মামা খেলা করছে ঝলমল আলো ছড়িয়ে। মনে হচ্ছে কোনো শিল্পীর তুলিতে যত্ন করে আঁকা অপরূপ এক কাল্পনিক শহর।

Portugal1.jpg

অনেকে বলতে শুনেছি ছবির মতো সুন্দর কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে তার চেয়ে বেশি কিছু এই শহর। আধুনিকতা ও প্রকৃতিক পরিবেশের মেলবন্ধনে একটি পরিপূর্ণ নগরী। পাহাড়ের কোল ঘেসে রাস্তা ও বাড়িঘরগুলো দেখলে নিমিষেই যে কারো মন ভালো করে দেবে। একটি স্মার্ট শহর বলতে যা বুঝি তার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজার হাজার পর্যটকে মুখরিত এক শহর।

নানা রংয়ের পর্যটকবাহী সাইট সিং বাসগুলোর অবিরাম ছুটে চলা বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণীয় স্থানে। আমিও আর দেরি না করে অফিসের কাজ সেরে নিতে লাগলাম যেন একটু তাড়াতাড়ি ঘুরতে বের হতে পারি। আগে থেকে হোটেল বুকিং দেয়া ছিল তাই চেক ইন সেরে মালামাল রেখে বেরিয়ে পড়লাম ও দুপুরের খাবারের আগে অফিসিয়াল কাজ শেষ করে নিলাম। পর্তুগালের সব শহরে সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায় এবং তা স্থানীয় ও পর্যটকদের কাছে খুবই প্রিয়। অন্যতম সুস্বাদু মাছ সেলমন, দোরাদো, কারাপো, বাকালাও এবং সারডিন ফিস।

শহরটি প্রধানত দুটি অঞ্চলে পরিচিত ওল্ড টাউন ও নিউ টাউন। ওল্ড টাউনে শতাধিকের বেশি ঐতিহ্যবাহী পর্তুগিজ খাবারের হোটেল রয়েছে এবং আমরা ওদের একটিতে রাতের খাবার শেষ করলাম। নিউ টাউনে রয়েছে অসংখ্য চোখ ধাঁধাঁনো স্টিপ বার যেখানে ২৪ ঘণ্টা বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয় পানের ব্যবস্থা ও পার্টি করার সুযোগ। রাস্তায় নিয়ন লাইটের আলোয় এই এক অন্য জগত মনে হয়েছিল।

Portugal1.jpg

বাচ্চাদের জন্য রয়েছে থিম পার্ক ও ওয়াটার পার্ক এবং অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থা। অসংখ্য ৩, ৪ ও ৫ তারকা হোটেলসহ রয়েছে আধুনিক পর্যটনের সব সুযোগ-সুবিধা যা নিমিষে যে কোনো ভ্রমণ-পিপাসু মানুষের মন কেড়ে নেবে। আমার কাছে আশ্চর্য মনে হয়েছে পর্যটকের জন্য সমুদ্র সৈকতে নামার চলন্ত সিঁড়ি দেখে। মানে সৈকত পাহাড়ের ৫০/৬০ ফুট নিচে তাই সহজে যাতায়াতের জন্য এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এখানকার ঘর-বাড়িগুলোও ছিল দর্শনীয় ঠিক যেন প্রকৃতি মায়ের কোলে বসবাস করছে মানুষজন কিন্তু প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করে। আটলান্টিকের পাড়ের সমুদ্র সৈকত যে এত সুন্দর হতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে কখনো বিশ্বাস হত না। হাজার হাজার পর্যটকে মুখরিত ছিল সৈকত এবং আমরা সমুদ্রে গোসল করে কূলে এসে আবার মিষ্টি পানিতে শরীল ভেজালাম। সৈকতের খুব নিকটে গোসলের এমন ব্যবস্থা করা আছে।

Portugal1.jpg

সমুদ্র তীরবর্তী রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য ছোট বড় পর্তুগিজ সুভীনিয়রের দোকান আছে যার বেশির ভাগের মালিকানা বাংলাদেশিদের দখলে। আমরা ঘুরে ফিরে সামান্য কেনাকাটা সেরে নিলাম। পুরো শহরের যেখানে পা রেখেছি সেখানেই দেখতে পেয়েছি আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের এক অনন্য মেলবন্ধন। খুব যত্ন করে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সম্মিলিত আধুনিক এক পর্যটন নগরীর নাম আল-বুফেরা।

মো. রাসেল আহম্মেদ/লিসবন, পর্তুগাল থেকে

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]