পুরুষতন্ত্রকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে

কৌশলী ইমা কৌশলী ইমা , যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৫:৩৪ পিএম, ০৯ মার্চ ২০১৯

‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ -আদিকালের এই প্রবাদ বর্তমানে আর খাটে না। এখন সবার মুখ ফোটে, কারো বুক ফাটে না। যুগের হাওয়া বদলে গেছে। নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে হবে। পুরুষতন্ত্রকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশই হলো গ্রাম ও পল্লী এলাকায় বসবাস করা নারী, যারা বিভিন্ন উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। তবে এখন সেই অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। অতীতে নারীরা বিয়ে নিয়ে নিজের মতামত দিতে পারতেন না, সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করতে পারতেন না। অনেকেই পরিবার থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন না। নারীরা আয় করলেও নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী খরচ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন সে অবস্থার ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে তা এখনও পুরুষের তুলনায় অনেক কম। এখনও প্রতিদিন কোথাও না কোথাও নারীরা সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ থেকে উত্তরণে কয়েক দশক ধরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে সরকারি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অপরদিকে যারা বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে তা প্রকল্প ভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে। তাই নিজের অধিকার আদায়ে নারীদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি পরিবারেরও বেশ কিছু ভূমিকা রয়েছে।

সেই সঙ্গে নারীর নিজেরও কিছু দায়িত্ব থাকতে হবে। স্বেচ্ছাচারী হয়ে পুরুষের প্রতি বিরূপ আচরণ করা যাবে না। সর্বোপরি নারী-পুরুষ উভয়কে পরস্পরের প্রতি সহনশীল হতে হবে।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক এমনকি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও নারীরা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রেখে চলেছেন। তবে বাংলাদেশে এখনও এমন অনেক পরিবার আছে, যেখানে নারী উপেক্ষিত। সামাজিকভাবেও নারীর অবস্থান সেভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

একটু পেছনে ফিরলে দেখা যাবে, এদেশে ডাকসুর ভিপি ছিলেন একজন নারী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও বাঙালি নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন, শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশের একজন নারী আন্তর্জাতিক দাবায় গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব পেয়েছেন। এভারেস্ট শৃঙ্গে দেশের পতাকা উড়িয়েছেন বাংলাদেশের নারী।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের মান হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ২০১৬ সালের জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭২। লিঙ্গবৈষম্য হ্রাসে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এরপরও তারা উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন। দেশে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটলেও বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যায়নি। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ১৮ বছরের আগেই মা হয়ে যান।

বাংলাদেশের উন্নয়নে নারীদের ভূমিকা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। শহুরে কিংবা নাগরিক জীবন নয়, দেশের সর্বত্রই নারীর গুরুত্ব আজ স্বীকৃত। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন অনেক বেড়েছে। সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সূচকে, সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশের যে বিস্ময়কর উত্থান, তার পেছনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে নারী। এত কিছুর পরও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বৈষম্য একেবারে দূর করা যায়নি।

এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। পুরুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে না পারলে নারীর নিগ্রহের ঘটনা ঘটতেই থাকবে, নির্যাতন কমবে না।

সিডও সনদের অনুমোদনকারী রাষ্ট্রগুলোর একটি বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী নারীর প্রতি বিদ্যমান সব ধরনের বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড, রীতিনীতি, প্রথা ও চর্চা নিষিদ্ধকরণ এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের; কিন্তু বাস্তবে তা কি প্রতিপালিত হচ্ছে? দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নারী নির্যাতনের চিত্র কি ইতিবাচক কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে? সমাজে এখনও নারীকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। নারীকে উপেক্ষা নয়, তাদের যোগ্য সম্মান দিতে হবে পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে শুক্রবার (৮মার্চ) এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইসলাম ধর্মই নারীর মর্যাদা সমুন্নত রেখেছে। এ ধর্মে নারীর অধিকারের কথা সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে। আর এসব নির্দেশনা এসেছে সুস্পষ্টভাবে। এজন্য ধর্মের নামে নারীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নারীদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে।

নারীর উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার নারী। পৃথিবীতে এ রকম আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমান সমান প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। নারী দিবসের শুরু ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সূঁচ কারখানার নারী শ্রমিকরা দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। সেদিন আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেফতার হন অসংখ্য নারী। কারাগারে নির্যাতিতও হন অনেকে। তিন বছর পর ১৮৬০ সালের এই দিনে গঠন করা হয় `নারী শ্রমিক ইউনিয়ন`।

১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার অধিকার। ১৯১০ সালের এই দিনে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এর পর থেকেই সারা বিশ্বে দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে। এর দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে পৃথিবী জুড়েই নারীর সমঅধিকার আদায় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশও প্রতিবছর যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালন করে।

এমএমজেড/আরআইপি

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]