বদলে গেছে মালয়েশিয়ায় ‘বাংলাদেশ দূতাবাস’

আহমাদুল কবির
আহমাদুল কবির আহমাদুল কবির , মালয়েশিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৩:৫৪ এএম, ০৩ নভেম্বর ২০১৮

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের চেহারা বদলে গেছে। ইতোমধ্যে এনালগ থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। আর সেবা কার্যক্রমে বিদেশিদের প্রশংসা কুড়িয়েছে হাইকমিশন। বাংলাদেশের শ্রমবাজারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রয়েছে দেশটি।

মালয়েশিয়ায় প্রায় ৮ লাখেরও বেশি বাংলাদেশির বসবাস। নানা প্রয়োজনে তাদের যোগাযোগ করতে হয় বাংলাদেশ দূতাবাসে। হাই কমিশনার মুহা. শহীদুল ইসলামের দিক-নির্দেশনায় কর্মকর্তারা প্রবাসীদের সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানান, শ্রম শাখার প্রথম সচিব মো. হেদায়েতুল ইসলাম মণ্ডল।

বিভিন্ন সময় মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, সাংসদ, মানবাধিকার, ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পরিদর্শন করে দূতাবাসের সেবার মানের প্রশংসা করেছেন এবং সরকার মালয়েশিয়ার এ মিশনকে প্রথম গ্রেডে উন্নীত করেছে বলে দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে, শ্রমিক বান্ধব দূতাবাস মালয়েশিয়ার পারটুবুহান পেঙ্গুসাহা বুঙ্গান বুঙ্গানান (অ্যাসোসিয়েশন) ক্যামেরুন হাইল্যান্ড কর্তৃক ইতোমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেশের বাইরে এই প্রথম সেবাদানে বিদেশিদের সম্মান কুড়িয়েছে।

southeast

পাহাং, দারুল মাকমুর মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট লি পেংফো বলেন, দূতাবাসের সব কর্মকর্তার আন্তরিকতার কারণেই ক্যামেরুন হাইল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশিরা সহজেই পাসপোর্ট করতে পারছে বলে বাংলাদেশ দূতাবাসের সকল কর্মকর্তাকে সংগঠনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ধন্যবাদ জানিয়েছেন সেবাপ্রত্যাশী প্রবাসীরাও।

হাই কমিশনার মুহা. শহীদুল ইসলাম বলেন, প্রবাসীদের নিয়েই আমার কাজ। দূতাবাস সব সময় প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। সকলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। সারাবিশ্বে পরিশ্রমী জাতি হিসেবে বাংলাদেশিদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।

সাধারণ শ্রমিকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রবাসীদের উদ্দেশ্য হাইকমিশনার শহীদুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি সবার ওপরই কিছু না কিছু দায়িত্ব বর্তায়।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রমিকরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। আর মালয়েশিয়ায় কর্মরত অন্যান্য দেশের নাগরিকের তুলনায় এ দেশের আইন-কানুন, নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলার ব্যাপারে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে।

দূতাবাসে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি ভিসা চালু হওয়ায় মালয়েশিয়ান নাগরিক ও ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশ ভ্রমণে আগ্রহ বেড়েছে ব্যাপক। গড়ে প্রতিদিন ১শ থেকে দেড়’শ ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে বলে জানান কন্স্যুলার শাখার প্রথম সচিব মো. মাসুদ হোসেইন।

সূত্র জানায়, দেশটিতে কর্মরত অবস্থায় বাংলাদেশিদের দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও ইন্স্যুরেন্সের ক্ষতিপূরণসহ বকেয়া পাওনা আদায়ে দূতাবাসের সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন।

southeast

হাই কমিশনার মুহা. শহীদুল ইসলামের দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতায় মিশনের সক্রিয় আইনি সহায়তায় চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ২ কোটি ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৮১৫ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে। গত আড়াই বছরে মালয়েশিয়া সরকার কর্তৃক অবৈধ বিদেশিদের বৈধতার প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী নিবন্ধিত হয়েছেন। নিবন্ধিতদের মধ্যে আড়াই লাখ কর্মী ভিসা পেয়েছেন। বাকিরা ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। গত দেড় বছরে জি-টু-জি-প্লাসে এসেছেন দুই লাখের মত কর্মী। আরও ৭০ হাজার কর্মী আসার অপেক্ষায় রয়েছেন।

এ ছাড়া মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধি ও মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে দূতাবাসের প্রথম সচিব (বাণিজ্যিক) মো. রাজিবুল আহসান এ প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে আমরা মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গন্তব্য। সে বিষয়টি মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে।

প্রশ্নের জবাবে মো. রাজিবুল আহসান বলেন, মালয়েশিয়া বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের সম্ভাবনাময় বাজার। মালয়েশিয়ান আসিয়ান বাণিজ্য অঞ্চলের একটি করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে আসিয়ানভুক্ত অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি পণ্যে ও রফতানি বাজার সম্প্রসারণ করার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি জানান।

মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল চেম্বার, অ্যাসোসিয়েটেড চাইনিজ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, মালয় চেম্বার অব কমার্স, ফেডারেশন অব মালয়েশিয়ান ম্যানুফ্যাকচার্স, মালয়েশিয়া রিটেইলার্স অ্যাসোসিয়েশন কুয়ালালামপুর, পারদাসামা, কুয়ালালামপুর সেলেঙ্গর ইন্ডিয়ান চেম্বার অ্যান্ড কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, জহুরবারু চাইনিজ চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব জহুর মালয়েশিয়া, সারওয়াক চেম্বার অব কমার্স, পেনাং চেম্বার অব কমার্স, কুচিং চাইনিজ জেনারেল চেম্বার অব কমার্স, ফেডারেশন অব সাবা ইন্ডাস্ট্রিজ, কোটা কিনাবালু চাইনিজ চেম্বারসহ প্রায় সব জাতীয় ও প্রাদেশিক চেম্বারের নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

আলোচনায় বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সার্বিক সহযোগিতা দিতে সম্মত হন মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ী নেতারা। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে ইকনোমিক জোনে বিনিয়োগে আগ্রহী। বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে শিগগিরই ব্যবসায়ী নেতারা বাংলাদেশ সফর করবেন বলে জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ হলো ৬৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১০ সালে ছিল ১১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বর্তমান সরকারের সময়ে মালয়েশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে বলে জানালেন কমার্শিয়াল উইং প্রধান মো. রাজিবুল আহসান। তিনি বলেন, ২০০৯-১০ সময়ের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে মাত্র ৮ বছরের ব্যবধানে মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশের রফতানি চারগুণ বেড়ে ২৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

southeast

জালান আম্পাং বেছারে খোলা হয়েছে পাসপোর্ট আবেদন, তথ্যসেবা, বিনা পয়সায় আবেদন ফর্ম পূরণসহ তাৎক্ষণিক সেবা প্রদানে চালু রয়েছে হটলাইন ও ওয়ানস্টট সার্ভিস।

সরেজমিনে জানা গেছে, যাদের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তারা রি-ইস্যু পাসপোর্টের জন্য আবেদনের সঙ্গে তার ভিসার ফটোকপি সংযুক্ত করে যে ক্যাটাগরির ভিসা রয়েছে সে ক্যাটাগরিতে আবেদন করতে হবে।

সাধারণ শ্রমিক এবং স্টুডেন্টের ব্যাংক ড্রাফ্ট ১১৬ রিঙ্গিত এবং এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে ভিসা ফটোকপি। আর যারা প্রফেশনাল ভিসায় অথবা ট্যুরিস্ট ভিসায় দেশটিতে অবস্থান করছেন তাদের ৩৮৫ রিঙ্গিতের ব্যাংক ড্রাফ্ট করে আবেদন করতে হবে।

এ ছাড়া যাদের পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে তাদের জন্য থানায় রিপোর্ট করে আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হবে। এদিকে মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (নতুন) রি-ইস্যু আবেদন গ্রহণ ও বিতরণ সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। দূতাবাসের জালান সুলতান ইয়াহিয়া পেট্রায় জন্ম নিবন্ধন, পরিচয়পত্র, প্রত্যয়ন, এলওআই, পারিবারিক সনদপত্র সত্যায়ন, আমমোক্তারনামা, ট্রাভেল পারমিট, মরদেহ সংক্রান্ত কেস আবেদনগ্রহণ, শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, আইনগত সহায়তা এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক ভিসা সংক্রান্ত আবেদন গ্রহণ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এবং বিতরণ সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে বিকেল ৪টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বাণিজ্যিক কাগজপত্র সত্যায়ন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। আবেদন গ্রহণ এবং বিতরণ একই দিন দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।

এ বিষয়ে দূতাবাসের পাসপোর্ট ও ভিসা শাখার প্রধান (প্রথম সচিব) মশিউর রহমান শুক্রবার এ প্রতিবেদককে বলেন, হাই কমিশনার মুহা. শহীদুল ইসলাম মহোদয়ের দিক-নির্দেশনায় আমরা প্রবাসী/শ্রমিকদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার জহুর বারু, পেনাং, মালাক্কা, সারওয়াক, ক্যামেরুন হাইলেন্ডসহ দূরের প্রদেশগুলোতে মোবাইল ক্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে পাসপোর্ট আবেদন ও ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে এবং বন্ধের দিন প্রতি মাসের শনি ও রোববার পাসপোর্ট সেবা দেয়া হচ্ছে। যাতে করে প্রবাসীদের পাসপোর্ট করতে এবং পাসপোর্ট পেতে অসুবিধা না হয়।

মশিউর রহমান বলেন, আগে যেখানে পাসপোর্ট সংক্রান্ত অথবা অন্য সমস্যা সমাধানের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে সিরিয়াল নিতে হতো সেখানে এখন দেয়া হচ্ছে তাৎক্ষণিক সেবা। গড়ে প্রতিদিন ১২শর অধিক সেবা প্রত্যাশীদের পাসপোর্ট সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে।

পাসপোর্ট সেবার উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে সচিব বলেন, ওয়ানস্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে। ২০১৭ সালে ২ লাখ ৭৪৩৪টি পাসপোর্ট আবেদনের বিপরিতে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৩১টি পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৮০টি আবেদন জমা পড়েছে। তন্মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৬৬টি পাসপোর্ট প্রদান করা হয়েছে।

নাম ও বয়স জটিলতায় অনেকে পাসপোর্ট পাচ্ছে না প্রশ্নের জবাবে মশিউর রহমান বলেন, যদি কেউ নাম ও বয়স গোপন রেখে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন তারাই সমস্যায় পড়ছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পূর্বের পাসপোর্টে নাম এবং বয়সের সঙ্গে নতুন আবেদনের সঙ্গে মিল থাকে না। ডিজিটাল পাসপোর্টে প্রথমে যে নাম এবং বয়স থাকবে সে অনুপাতেই পাসপোর্ট হবে। ঘষা-মাঝার কোন সিস্টেমই নেই।

পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন পাসপোর্ট করতে আসা মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা যেকোনো প্রয়োজনে সহজেই দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি এবং খুব দ্রুত সেবা পাচ্ছি। আগে চাইলেই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব ছিল না। এখন পাসপোর্ট এবং ভিসার ব্যাপারে সহজেই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। আমরা আরো উন্নত দূতাবাসের আশা প্রকাশ করেন মনোয়র।’

প্রবাসী মামুন আহমদ এ প্রতিবেদককে বলেন, হাই কমিশনের বর্তমান সেবা পদ্ধতি সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এ পদ্ধতি অব্যাহত থাকায় দালদের দৌরাত্ম কমে এসেছে। তবে এখনও যারা দালালদের প্ররোচণায় হেনস্তা হচ্ছেন তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এমআরএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]