সিন্ডিকেটমুক্ত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, আলোচনার পর নতুন সিদ্ধান্ত
জিটুজি-প্লাসের এসপিপিএ সিস্টেম বাতিল করেছে মালয়েশিয়া সরকার। আর এ সিস্টেম বাতিলের মধ্যদিয়ে সিন্ডিকেটমুক্ত হলো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। তবে উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার পর আসছে নতুন সিদ্ধান্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাছ থেকে ব্যাপক অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে বাংলাদেশের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সিকে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে সমস্ত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নোটিশ জারি করেছে মালয়েশিয়া সরকার। মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতায় আসার পরপরই ব্যাপক আলোচনায় থাকা বাংলাদেশের শ্রমবাজার সিন্ডিকেটের ব্যাপারে সোচ্চার হয় মালয়েশিয়া সরকার, অভিবাসন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
গত মঙ্গলবার (২১ আগস্ট) দেশটির হোম ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল দাতো ইন্দেরা খাইরুল দাজমি বিন দাউদ স্বাক্ষরিত ওই নোটিশে জানানো হয়, বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার ব্যাপারে বিগত সরকারের স্বাক্ষরিত সমস্ত কার্যক্রম থেকে বাংলাদেশের ১০ এজেন্সির এসপিপিএ সিস্টেম সেপ্টেম্বর থেকে বাতিল করা হলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ৪০ হাজার টাকার জায়গায় চার লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সিকে শ্রমিক পাঠানোর সমস্ত কার্যক্রম স্থগিত করে মালয়েশিয়া সরকার। মালয়েশিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশি এক নাগরিক ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কোটি কোটি টাকার অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১০ এজেন্টকে শ্রমিক নিয়োগের দায়িত্ব দেয়। বাংলাদেশে থেকে আসা শ্রমিকরা মালয়েশিয়ায় অধিকাংশ মালিকের কাছে স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশি এজেন্টের হাতে জিম্মি হয়ে চার লাখ টাকার বিনিময়ে তারা এদেশে এসেছেন। এত টাকার বাণিজ্য, আস্তে আস্তে এটা মালয়েশিয়ায় প্রচার হতে থাকে এবং সর্বশেষ মালয়েশিয়ার মন্ত্রী পর্যায়ে চলে যায়। পুরো ঘটনার তদন্তে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারার কাছে প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আর পুরো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন মালয়েশিয়ার সাবেক এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাংলাদেশি-মালয়েশিয়ান নাগরিক আমিন।
মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, পুরো বিষয়টি তদন্ত করে আমরা আবার আগের সিস্টেমে ফিরে যাব, এতক্ষণে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ থাকবে। তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা চলছে এবং আমি বিশ্বাস করি যে আমরা শিগগিরই সমাধান খুঁজতে সক্ষম হবো। পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হবে এবং স্বচ্ছতার মধ্যদিয়ে শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হবে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় শ্রমিক গেছেন এক লাখ ৯০ হাজার ৫৬২ জন। বাতিল হওয়া এসপিপিএ সিস্টেমে গত দেড় বছরে এক লাখ ৭৯ হাজার ৩৩০ জন মালয়েশিয়ায় গেছেন। তাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৩শ ৮০ কোটি টাকা। খরচ হওয়ার কথা ছিল ৬৭৬ কোটি টাকা।
এর আগে চলতি মাসের ১৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত 'স্পেশাল কমিটি অন ম্যানেজমেন্ট অব ফরেন ওয়ার্কার্স ইন মালয়েশিয়া'র সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে এসপিপিএ সিস্টেম বাতিল করা হয়। মালয়েশিয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত একটি চিঠিতে জানানো হয়েছে যে, এ বিষয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বিস্তারিত স্টাডি করে এবং উভয় দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে। অর্থাৎ এসপিপিএ সিস্টেমে অনলাইন পদ্ধতিতে চলমান কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। এতে করে বাংলাদেশের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনা বন্ধ হলো।
তবে অন্য কোনো এজেন্ট বা কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনা হবে কি না বিষয়টা পরিষ্কার নয়। মালয়েশিয়ায় সক্রিয় জনশক্তি আমদানিকারকরাও সঠিক কোনো তথ্য নিশ্চিত করতে পারেননি। কারও ধারণা অন্য কোনো সিস্টেমে, আবার কারও ধারণা পুরনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হবে। বাংলাদেশের জনশক্তি সংশ্লিষ্টদের মধ্যেও রয়েছে বিভ্রান্তি। অধিকন্তু জিটুজি-প্লাস বাতিল করা হয়েছে এমন মিথ্যা ও ভুল তথ্য প্রচারের কারণে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে বলে মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
একটি সূত্রে জানা গেছে, জিটুজি-প্লাস পদ্ধতিতে এসপিপিএ ডিজিটাল তথা অনলাইন সিস্টেম যা মালয়েশিয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে কোম্পানির তথ্য, প্রাপ্ত কোটার তথ্য, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ও ডিমান্ড লেটার দেয়া থাকে। অনলাইনে দূতাবাস এটেস্টেশন করে বাংলাদেশে বিএমইটি, রিক্রুটিং এজেন্ট, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে এবং নিয়োগকারী কোম্পানিকে জানিয়ে দেয়। এই অনলাইন সিস্টেমে অটোমেটিক পদ্ধতিতে ১০ এজেন্সি নির্ধারিত হয়। এই ১০ এজেন্টের বাইরে অন্য কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির কাজ করার সুযোগ ছিল না। এটাকেই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী 'মনোপলি' বলে প্রেসব্রিফিংয়ে বলেছিলেন। এর ফলে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় নিয়েও ছিল নানান প্রশ্ন। এ মনোপলি যাতে না হয় এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের সকল রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়া সরকারের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছিল কিন্তু মালয়েশিয়ার পূর্বতন সরকার দশ এজেন্ট ঠিক করে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয়। এর বিরুদ্ধে অন্যান্য এজেন্ট সোচ্চার হয় এবং হাইকোর্টে মামলা পর্যন্ত গড়ায়।
উল্লেখ্য, ২০০৬ ও ২০০৭ সালের পর মালয়েশিয়ায় ভুয়া কোম্পানি দেখিয়ে, ভুয়া পারমিট দেখিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোক এনে এবং সাগর ও আকাশ পথে অবৈধভাবে লোক এনে মালয়েশিয়ায় অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলে দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনা বন্ধ রেখেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমে জিটুজি পদ্ধতিতে লোক প্রেরণ করে তখন মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে কোনো জনশক্তি রফতানিকারক সংশ্লিষ্ট ছিল না। এটা দাবি ছিল যে তাদের যেন সুযোগ দেয়া হয় সে প্রেক্ষিতে জিটুজি-প্লাস অর্থাৎ বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানকারকরাও সুযোগ পেয়েছে।
বিএ/এমএস