মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিরা বিরামহীন কাজ করেও সয়ে যাচ্ছেন বঞ্চনা

আহমাদুল কবির
আহমাদুল কবির আহমাদুল কবির , মালয়েশিয়া প্রতিনিধি মালয়েশিয়া
প্রকাশিত: ০৪:২৭ পিএম, ০৫ আগস্ট ২০১৮

অভাব ঘুচিয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে বিরামহীন কাজ করে চলেছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। তাদের দিন-রাত পরিশ্রম আর রক্ত পানি করা অর্থে দিনে দিনে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার সমৃদ্ধ হলেও নিজেরা সয়ে যাচ্ছেন বঞ্চনা-লাঞ্চনা।

আয়ের প্রায় সব টাকা দেশে পাঠিয়ে অনিশ্চিত জীবনের মুখে পড়ছে মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। যৌথ পরিবারের বৃহত্তর দায়িত্বের টানে ভিনদেশে রাত-দিন সমানে তারা খাটছে হাড় ভাঙা খাটুনি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আয়-রোজগারও করছে। কিন্তু নিজের থাকা-খাওয়া-চলাফেরার জন্য ন্যূনতম খরচ রেখে সব টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশে।

এদের কেউ কেউ টাকা জমানো আর জমি কেনার মতো দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেও অধিকাংশই ভবিষ্যতের কথা ভাবে না।

কাজে যোগ দিতে হয় সকাল সাতটায়। বিকেল সাতটায় ছুটি। ছুটি না বলে যায় ফের নতুন কাজে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি। রাত ১২টা পর্যন্ত চলে কাজ। সময় দিতে হয় আরও ৫ ঘণ্টা। নিজের জন্য সময় বলতে ৪ ঘণ্টা। এ সময়ের ভেতরেই ঘুম, আনুষঙ্গিক কাজ।

অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি, পরিবারকে ভালো রাখতে প্রবাসে এভাবেই দিন কাটছে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের।

মালয়েশিয়ার পর্টিকসন জিমাহ এ্যনার্জি পাওয়ার প্লান্টে কাজ করছেন আমিরুল, শরিফ নাসির, পিন্টু। পর্যটক ভিসায় ২০০৭ সালে তারা এসেছিলেন মালয়েশিয়ায়। উদ্দেশ্য বেড়ানো নয়, কাজ করে নিজের পরিবারের অভাব ঘোচানো। ছিলেন অবৈধ শ্রমিক। পরে সরকারের দেয়া সুযোগ নিয়ে বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।

এখানে ১২ ঘণ্টা ডিউটি। সকাল সাতটায় কাজে যোগদান, রাত ১২টায় ফেরা। বছরের পর বছর ধরে এই রুটিনে কাজ করছেন তারা। মালয়েশীয় মুদ্রায় বর্তমান বেতন ১ হাজার ৩০ রিঙ্গিত। যার বাংলাদেশি মান প্রায় সাড়ে ২২ হাজার টাকা। থাকা খাওয়া নিজের। তবুও এ টাকায় প্রবাসে বাসা ভাড়া, খাওয়া খরচা বাদে নিজের হাতেই বা অবশিষ্ট কি থাকে। আর দেশেই বা পাঠাবেন কি?

কাজ করতে গিয়ে দিন রাতের ২৪ ঘণ্টার ২০ ঘণ্টাই চলে যায় তাদের। তাহলে তারা ঘুমান কখন! কর্মস্থলেই বা যাওয়ার সময় দেন কখন?

‘এটাই তো কেউ বুঝতে চায় না। এর মধ্যেই বিরতির সময় একটু জিরিয়ে নেয় তারা।’- জীবনকে যন্ত্রে পরিণত করা এমন আরও অনেকের দেখা মিলবে এদেশে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কিংবা রক্ত পানি করা পরিশ্রমের বিনিময়ে সামান্য অর্থ উপার্জনের গল্পটি-ও সবার মোটামোটি একই ধরনের।

পরিবার পরিজনের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই কষ্ট করছেন তারা। পরিজনরা যদি একটু সুখে শান্তিতে থাকে এ আশায় শ্রম দিচ্ছেন আমিরুল, শরিফ, নাসির, পিন্টুরা।

কাজের ফাঁকে আলাপ হয় এ প্রতিবেদকের সংঙ্গে। কথার এক পর্যায়ে ঝাপসা হয়ে আসে আমিরুল, শরিফ, নাসির ও পিন্টুর দুটি চোখ। চোখের সামনে তাদের ভেসে ওঠে পরিবার পরিজনের কথা। তিন বছর ধরে চোখের আড়ালে ওরা।

দেশ, রাষ্ট্র, নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে নানা চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে মেলাতে গলা ধরে আসা আমিরুলের দুই চোখ উত্তর খুঁজছিলো নানা প্রশ্ন।

কিন্তু কত টাকা দেশে পাঠিয়েছেন সে হিসাব আজ তার নিজেরও অজানা। আমিরুল জানান, এ দেশে আসার পর প্রথম দু’মাসে পাঠাই ৭০ হাজার টাকা। তারপর থেকে আয় বুঝে প্রতি মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দেশে পাঠাচ্ছি। ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা নিজের কাছে রাখছি খরচের জন্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালয়েশিয়া থাকতে প্রতিমাসে ৫০০ রিঙ্গিত ব্যয় হয় শ্রমিকদের। সেটা রেখে গড়ে ১ হাজার রিঙ্গিত করেই দেশে পাঠায় প্রতিজন। এরপরে সঞ্চয়টা কঠিনই হয়ে পড়ে বটে।

যদিও সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের পর এই মালয়েশিয়াতেই শ্রম দিচ্ছে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি। সব মিলিয়ে এ সংখ্যাটা ৭/৮ লাখের কম না। চলতি বছরের গেলো ৬ মাসে মালয়েশিয়া থেকে এই বাংলাদেশি প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ২৬৮ কোটি ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৫১ রিংগিত যা বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ৮১৩ কোটি ৭৬ লাখ ৪ হাজার ৫১১ টাকা।

নিজের চিন্তা না করে দেশ থেকে অনেক দূরে পরিবার-পরিজনের জন্য কলুর বলদের মতো খেটে যায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা। নিজের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে ভালো রাখে পরিবার-পরিজনকে।

এমআরএম/আরআইপি

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]