মালয়েশিয়ায় থামছে না মানব পাচার


প্রকাশিত: ০৬:০৪ এএম, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬

বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচার আশায় নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দালালের হাত ধরে অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন বহু বাংলাদেশি। স্বপ্নের দেশে গিয়ে অনেকেই এখন জীবনের নিরাপত্তা নিয়েই শঙ্কিত। বৈধ কোনো কাগজ পত্র না থাকায় ভয়ে জঙ্গলে রাত্রি যাপন করছেন। অনেকে আবার চাকরি করলেও পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি।

রাজধানী কুয়ালালামপুর ছাড়াও কোতাবারু, পেনাং, জহুরবারু, ক্যামেরুন হাইল্যান্ড, ইপো, পেটালিং জায়া, শাহালমে কর্মরত শ্রকিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের ভয়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন পাহাড় ও জঙ্গলে। অবৈধ বলে নিয়োগকর্তাদের সব জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে তাদের। কথা বললে পুলিশের ভয় দেখিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে।

গত মঙ্গলবার ক্যামেরুন হাইল্যান্ডের একটি কনস্ট্রাকশন সাইটে দেখা হয় ২০ জনের মতো বাংলাদেশি শ্রমিকের সঙ্গে। সেখানে কর্মরতদের একজন ছাড়া বাকি সবাই অবৈধ।

তাদের মধ্যে মাছুম নামের এক শ্রমিক এ প্রতিবেদককে জানান, ২০১২ সালে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বৈধপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। কুয়ালালামপুরের শ্রি পেতালিংয়ে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন এক বছর। এসময় কম হলেও ১০ বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এখানকার পুলিশও দশবিশ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়।

Malaysia

তিনি আরো বলেন, ঝামেলা এড়াতে রাজধানীর মায়া ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে ক্যামেরুন হাইল্যান্ডে চলে আসি। এখানে কম বেতনের কাজ করলেও শান্তি ছিল। হঠাৎ উওপ্ত হয়ে ওঠে এ স্থানও। সেনাবাহিনীকে নিয়ে চিরুনি অভিযান চালায় সে দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশ। একই বাগানে কাজ করা আমরা ১৪ জন টানা চারদিন পাহাড়ের গুহায় পালিয়েছিলাম। পরিস্থিতির অবনতি দেখে অনেকেই পাশের প্রদেশে পালিয়ে যায়।

কুয়ালালামপুরের পিজে একটি কনস্ট্রাকশনে কাজ করেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বুরা খালি গ্রামের  ৬৫ বয়স্ক  সবুর মিয়া। এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, ৩ বছর আগে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাবার কথা বলে এক দালাল তাকে নিয়ে যায় টেকনাফে। সেখান থেকে চোখ বেঁধে নৌকায় তুলে নিয়ে আসে থাইল্যান্ডে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে এক বছর থাকার পর ২০১৫ সালের প্রথম দিকে দালাল চক্র তাকে নিয়ে আসে মালয়েশিয়া। এভাবেই কেটে গেছে মোট ৩ টি বছর। লুকিয়ে অবৈধ ভাবে কাজ করছেন তিনি। বৈধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।  

কন্সট্রাকশনে পালিয়ে কাজ করা বাংলাদেশিদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একদিকে বন-জঙ্গলে মশা ও পোকামাকড়ের উপদ্রপ, খাদ্য-বাসস্থানের অভাব। অন্যদিকে, পুলিশের অভিযান। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে সেদেশের ইমিগ্রেশন পুলিশ অভিযান চালিয়ে শতশত অভিবাসীকে গ্রেফতার করছে। এভাবে শুধুমাত্র চলতি বছরেই ৪৯ হাজার ২২২ জন অবৈধ বিদেশি শ্রমিক আটক আটক করেছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ।

মালয়েশিয়ার উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক নূর জাজলান মোহামেদ এই তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, এই সময় ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭১২ জন অবৈধ শ্রমিককে দেশে পাঠানোর জন্য জয়েন্ট ভলান্টারী ডেপোর্শন থ্রি-প্লাস ওয়ান প্রোগ্রাম করা হয়।

Malaysia

থ্রি-প্লাস ওয়ান প্রোগ্রাম শুরু ২২ জুলাই ২০১৪ থেকে। ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৭৯ জন অবৈধ বিদেশি শ্রমিক তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে রাজি হয়েছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে মন্ত্রী জানান,   দেশে ফেরত পাঠানোর আগে সব অবৈধ শ্রমিককে ব্ল্যাকলিস্ট করা হবে।

নূর জাজলান বলেন, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়া ইমিগ্র্যাশন ডিপার্টমেন্টের রেকর্ড অনুযায়ী ১৮ লাখ ৫৬ হাজার ৮৬৯ জন বিদেশি শ্রমিক দেশটিতে বৈধভাবে কাজ করছেন।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইমিগ্র্যাশন বিভাগ বিভিন্ন ভাবে নিশ্চিত করছেন অবৈধভাবে কোনো বিদেশি যেন মালয়েশিয়াতে ঢুকতে না পারে। তবে সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় এক বছর ধরে চলছে রি–হিয়ারিং প্রোগ্রাম।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এ সময় পর্যন্ত কতজন বাংলাদেশি নিবন্ধন করেছে এ তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রকাশ না করলেও স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে এখনও ২.২ মিলিয়ন অনিবন্ধিত বা অবৈধ শ্রমিক দেশটিতে বসবাস করছে। যে সকল অবৈধ বাংলাদেশি এখনো এ প্রকল্পের আওতায় আসেনি,তাদেরকে দ্রুত নিবন্ধন করতে হবে। এ প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিকে তেমন সাড়া না পেলেও চলমান সময়ে নিবন্ধনে আগ্রহীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

Malaysia

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ কর্মীর প্রায় ৬৫ শতাংশ এখনো এ প্রকল্পের আওতায় আসেনি। যারা এখনো নিবন্ধন করেনি তাদেরকে ৩১ ডিসেম্বরে মধ্যে অনলাইনে নিবন্ধন করে বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করার আহ্বান জানিয়েছেন দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম।

এদিকে মালয়েশিয়া সরকারের বৈধকরন প্রক্রিয়ার ধীর গতির অভিযোগ তুলছেন এর আওতায় আসা কর্মীরা। প্রথম ও দ্বিতিয় ধাপ সম্পন্ন করার পরও হাতে পাচ্ছেন না পাসপোর্ট। তবে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের সম্যসা নেই, সময় বেশি লাগলেও তাঁরা পাসপোর্ট পাবেন।

ইমিগ্রেশন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, যারা পুনঃনিবন্ধনে অংশ নিচ্ছেন না এবং যে কোম্পানির মালিক অবৈধ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার ১৯৫৯/৬৩ অনুচ্ছেদের ৫৫ (বি) ধারা মোতাবেক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবৈধ শ্রমিক পাওয়া গেলে মালিকপক্ষ ও কর্মচারীকে ৫০ হাজার রিঙ্গিত জরিমানাসহ এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হবে।

অন্য আরেকটি আইনে বলা হয়েছে, কোনো মালিকপক্ষ যদি পাঁচজনের বেশি অবৈধ শ্রমিক রাখে তাহলে পাঁচবছরের জেল কার্যকর হবে।

মালয়েশিয়ায় চলমান ‘অবৈধ’ বিদেশি শ্রমিকদের বৈধকরণ (রি-হায়ারিং) প্রকল্পে এ পর্যন্ত এক লাখ ৪০ হাজার বাংলাদেশি নিবন্ধন করেছেন। তবে এখনও বহু বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিক বৈধতার জন্য আবেদন করেননি।

এমএমজেড/জেআই

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]